মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

|

ভাদ্র ৩১ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

চোখে মুখে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, সবার নজর গারদ আর প্রিজন ভ্যানের দিকে

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:২৮, ৩০ জুলাই ২০২৪

আপডেট: ১২:৪১, ৩০ জুলাই ২০২৪

চোখে মুখে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, সবার নজর গারদ আর প্রিজন ভ্যানের দিকে

আদালত প্রাঙ্গণ

শিশু আমির হামজাকে কোলে নিয়ে একবার থানায় আরেকবার কোর্টে দৌড়াচ্ছেন জান্নাতুল ইসলাম মিতু। চোখে মুখে তার আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর হতাশার চাপ। মিতুর স্বামী মাহমুদ হোসেন রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেল চালক। পুলিশ তাকে বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার করে কোর্টে চালান করে। কোটা আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের দেলপাড়া এলাকায় এসবি কম্পোজিট নামের একাটি গার্মেন্টে আগুন দেয়ার ঘটনায় দায়ের করা বিস্ফোরক আইনের মামলায় আসামি করা হয়।

মিতু জানান, ‘আমার শ্বশুর বাঁইচা নাই, শাশুড়ি চোখে দেখেন না। আত্মীয়-স্বজনদের কেউ এই সময়ে থানা-পুলিশের কাছে যাইতে চায় না। বাধ্য হয়ে ছোট শিশুটাকে কোলে নিয়ে একবার থানায়, আরেকবার কোর্টে দৌড়াচ্ছি আমি। আমাদের কোনো সঞ্চয় নেই। ধারদেনা কইরা একজন উকিল ধরছি; কিন্তু কোর্টে তার জামিন হয় নাই।’

মিতু বলেন, সদর উপজেলার ভূঁইগড় এলাকায় থাকেন তারা। আন্দোলনের পাঁচ দিন বাড়িতেই ছিলেন মাহমুদ হোসেন। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে কারফিউর মধ্যেই জীবিকার তাগিদে মঙ্গলবার মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন তিনি। কয়েক মাস আগে কিস্তিতে মোটরসাইকেলটি কেনেন। তাদের ছোট্ট শিশুর খাবার দুধ শেষ। প্রতি সপ্তাহে এক প্যাকেট দুধ লাগে। আর বাসায় টাকা নেই যে দুধ কিনে আনবে। তখন আমার স্বামী বলল এখন তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক তাহলে দুই-তিনটা ট্রিপ মেরে পোলার (ছেলে) দুধ কিনে নিয়ে আসি। এই বলে দুপুরে বের হয়। রাত ৯টার দিকে বাসায় ফেরার পথে ভূঁইগড় রূপায়ণের সামনে থেকে ডিবি পুলিশ আটক করে নিয়ে আসে।

মিতুর মতো শত শত অভিভাবকের ভিড় এখন নারায়ণগঞ্জে আদালত প্রাঙ্গণে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গ্রেফারকৃতদের একনজর দেখতে ও জামিনের জন্য ভিড় করছেন তাদের আত্মীয়-স্বজন। এ চিত্র এখন নিত্যদিনের। নারায়ণগঞ্জ আদালতপাড়ার গারদের সামনে বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছেন তার সন্তানের জন্য। স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন তার স্বামীর জন্য। নানী দাঁড়িয়ে আছেন তার নাতির জন্য। একনজর দেখার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে খাবার নিয়ে, আবার কেউ দাঁড়িয়ে আছেন কাপড়-চোপড় নিয়েও। সবারই চোখে মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সবার নজর গারদ আর প্রিজন ভ্যানের দিকে।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় সোমবার পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলার পাঁচটি থানায় ২৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলার বাদি পুলিশ। এসব মামলায় পাঁচ হাজারের অধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৬৩ জনকে।

সোনারগাঁওয়ের পরমেশ্বরদী গ্রামের ১৮ বছর বয়সী মো: আলমকে স্থানীয় একটি মাছের ঘের থেকে আটক করে সোনারগাঁও থানা পুলিশ। আলমের বাবা আক্তার হোসেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী বলে জানান তার বড় বোন শিরিনা।

তিনি বলেন, ‘আমার ভাই দিনে দিনমজুরি করে আর রাতে একটি মাছের ঘের দেখাশোনা করে। ওই রাতে ঘেরেই ছিল সে। ঘের থেকেই চারজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। আমরা থানায় গিয়ে পুলিশকে বলেছি যে, আমাদের পরিবার আওয়ামী লীগ পরিবার। আমরা কোনো ঝামেলার সাথে নাই; কিন্তু পুলিশ কোনো কথাই শোনে নাই।’

শিরিনা একটি প্রত্যয়নপত্রও দেখান, যাতে নোয়াগাঁও ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সই রয়েছে। ওই প্রত্যয়নপত্রে আলমসহ আরো দুইজনের নাম উল্লেখ করে লেখা রয়েছে ‘তারা নোয়াগাঁও ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এবং তারা আওয়ামী পরিবারের সন্তান। তারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে সবসময় সম্পৃক্ত থাকেন। তারা দীর্ঘ দিন যাবৎ আওয়ামী লীগ আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত।’

পরমেশ্বরদী গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল ইসলাম ভূঁইয়া নিজেও এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি ওই রাতে গ্রেফতার চারজনের মধ্যে তিনজনের জামিনের জন্য আদালতে লড়ছেন।

গ্রেফতার হওয়া অনেক আসামির পরিবারের অভিযোগ, যাদের স্বজনরা নাশকতার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন তারা সবাই নিম্ন আয়ের। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন বলে পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন।

একইভাবে মামলার আসামি হয়েছেন রাজমিস্ত্রি আরিফ হোসেন (১৯)। সোনারগাঁও উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের পরমেশ্বরদী গ্রামের জয়নাল মিয়ার ছেলে সে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সোনারগাঁও থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।

আরিফ হোসেনের নানী জনু বেগম বলেন, ‘ছয় মাসের একটি শিশু সন্তান আছে আরিফের। আমার নাতি রাজমিস্ত্রির কাম করে বাবা। আমি আমার নাতির সঙ্গে খাই। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর কাজ শেষে বাড়িতে ফেরে সে। খাওয়াদাওয়া করে ঘুমায়। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ এসে ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। আমি তাদেরকে বলছি- আমার নাতি রাজমিস্ত্রির কাম করে সে বিএনপি করে না। তারা আমার কথাটাও শুনলো না। আমার নাতিরে ধরে নিয়ে নাশকতার মামলা দিলো।’

এক দিকে জেলাজুড়ে দুই ডজনের বেশি মামলা, অন্য দিকে পাঁচ শতাধিক গ্রেফতার। ফলে নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালত চত্বরে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের উপস্থিতি প্রতিদিনই বাড়ছে।

আইনজীবীদের অনেকে অভিযোগ করে বলেছেন, আদালতে পুলিশের কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক মামলাগুলোর নথিপত্র সরবরাহ করছেন না। এমনকি মামলার এজাহার পর্যন্ত দেখতে পারছেন না আইনজীবীরা। এমন চর্চা তারা আগে কখনো দেখেননি। ফলে কোনো ধরনের ‘কেস স্টাডি’ ছাড়াই জামিন শুনানিতে অংশ নিতে হচ্ছে তাদের।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য মাজেদুল হক রাজন জানান, তার কাছে দু’টি মামলায় গ্রেফতার আসামির স্বজনরা এসেছেন। তাদের পক্ষে তিনি আদালতে জামিন শুনানিতে অংশ নিয়েছেন কেবল নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ওপর ভিত্তি করে। আদালত পুলিশের কাছে গিয়েও ওই সংক্রান্ত মামলা দু’টির কোনো নথি তিনি পাননি।

আইনজীবী ওমর ফারুক নয়ন জানান, মামলার নথিপত্র পাওয়ার জন্য আবেদন করা অন্তত ১০ জন আইনজীবীর একটি দল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে দেখা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এমনটা আমরা কখনো দেখিনি যে, আইনজীবীরা মামলার এজাহার পাচ্ছেন না। আমরা বিষয়টি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছি। তিনি এ বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।

নারায়ণগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক আব্দুর রশীদ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি অন্য স্বাভাবিক সময়ের মতো না। আমরা সাধারণ মামলাগুলোর নথিপত্র আইনজীবীরা চাইলে সরবরাহ করি; কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট আদালতের অনুমতি নিয়ে এলে নথি সরবরাহ করা হবে বলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা আছে।’

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) গোলাম মোস্তফা রাসেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালাচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন দাবি করতেই পারেন, এ অধিকার তাদের আছে; কিন্তু পুলিশ কাউকে অযথা হয়রানি করছে না।’