শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

|

পৌষ ১১ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

শীতলক্ষ্যা বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ বন্ধ কি আদৌ সম্ভব!

প্রকাশিত: ০২:০৮, ২১ আগস্ট ২০২০

আপডেট: ০৬:০০, ৩০ নভেম্বর ১৯৯৯

শীতলক্ষ্যা বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ বন্ধ কি আদৌ সম্ভব!

নারায়ণগঞ্জের শিল্পকারখানায় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) না থাকায় শিল্পকারখানার বর্জ্যে পরিবেশ দূষিতসহ শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানি দুষিত হয়ে পড়ছে। এতে করে দুই নদীর পানি ব্যবহারের একেবারেই অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। শিল্পকারখানার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় আইনকে কোন তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য সরাসরী দুই নদীতে পাচার করছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো মাথা ব্যথা না থাকায় ও শিল্প মালিকরা ইটিপি স্থাপন না করার ফলে নদীর পানি পর্যায়ক্রমে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

এদিকে শীতলক্ষ্যা-ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা নদীর সংযোগ সরকারী খাল দখল করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা স্থাপনা নির্মান করে রখেছে। প্রভাবশালীরা প্রতিযোগিতা করে খাল দখল স্থাপনা নির্মান করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি সরকারী অনেক খাল দখল আর দূষন দেখে আর বুঝার কোন উপায় নেই এটি খাল নাকি ড্রেনের সুয়ারেজ লাইন। এমনকি অনেক শিল্পকারখানার মালিকরা খাল দখল করে বিশাল আকারে দেয়াল নির্মানসহ বিশাল আকারের ভবন নির্মান করে নিজেদের দখলে নিয়ে যায়।

জানা গেছে, বিগত তত্তাববধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে প্রতিটি শিল্প-কারখানায় ইটিপি বা বর্জ্য পরিশোধন প্রকল্প বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এতে প্রতিষ্ঠান মালিকদের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া মেলেনি। পরবর্তীতে ২০১০ সালের জুন মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়। যেসকল শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে তরল বর্জ্য নিপ্তি হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে ডাইং ফ্যাক্টরি, পাল্প অ্যান্ড পেপার মিল, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, সুগার মিল, অয়েল রিফাইনিং, টারবাইন পরিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলার শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে নেই তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি)। দেড়শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ইটিপি স্থাপন করা হলেও সেগুলো ঠিকমতো চলছে না। এর মধ্যে শুধু সিদ্ধিরগঞ্জে ৩২ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮টিতে ইটিপি নেই। 

সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে নীট কনসার্ণ গ্রুপে গত (২০১৫) বছরের অক্টোবরে ১৪.৫০ লক্ষ্য টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ প্রতিষ্ঠানটিতে ইফুলেন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থাকার পরেও ক্যামিকেলের পরিশোধন পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুসারে মানমাত্রার মধ্যে না থাকায় এ জরিমানা করা হয়। গত দুইবছরে পরিবেশ অধিদফতর প্রায় ৫/৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করলেও থামছে না দূষণ। প্রায় সময় শিল্পকারখানায় ইটিপি মনিটরিং করতে গিয়ে শিল্পকারখানার লোকদের বাধার মুখেও পড়তে হচ্ছে পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের। বিভিন্ন শিল্প বর্জ্যরে কারণে দেশের দ্বিতীয় দুষিত নদী হিসেবে চিহ্নিত শীতল্যা এখন মুমূর্ষ প্রায়। আর বুড়িগঙ্গা নদীর কথা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। কারন বুড়িগঙ্গা নদীটি ঢাকা সিমানা অনেক বেশি। তাই বুড়িগঙ্গা দূষনমুক্ত করতে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহন করছেন। 

এর মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ফতুল্লার নয়ামাটি এলাকায় অবস্থিত রূপসী গ্রুপ। যার মালিক বিকেএমইএর একজন সাবেক পরিচালক। রূপসী গ্রুপকে পরিবেশ অধিদফতর জরিমানা করার পর প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ রিট দায়ের করে জরিমানার অর্থ আর প্রদান করেনি। এছাড়া তারা পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের হুমকিও দিয়েছে। পঞ্চবটির ইমপেরিয়াল ডাইংকে সম্প্রতি জরিমানা করলেও তারা মামলা দায়েরের মাধ্যমে ইটিপি স্থাপন করেনি। রূপগঞ্জের যাত্রামুড়ার সাহেবা টেক্সটাইলকে দুদফা জরিমানা করার পরে তারা ইটিপি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। জরিমানা দেয়ার পর ইটিপি নির্মাণ শুরু করেছে ফতুল্লার শিবু মার্কেটের ওসমান নিটেক্স। এছাড়া অনেক শিল্পকারখানার মালিক আইনকে তোয়াক্কা না করে কারখানায় ইটিপি স্থাপন করছে না।

নারায়ণগঞ্জে ৩৪৪টি তরল বর্জ্য নির্গমণকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে কিছু সরাসরি ও কিছু ড্রেনের মাধ্যমে বর্জ্য নির্গমণ করে যাকিনা নদীতে এসেই পড়ছে। ফলে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানিতে দিন দিন অক্সিজেনের পরিমান কমে আসছে। পানিতে জীববৈচিত্রের জন্য ন্যুনতম ৪.৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকার কথা থাকলেও শীতল্যাতে রয়েছে মাত্র ০.৫ মিলিগ্রাম। বর্ষাকালে কিছুটা বেড়ে ২ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এখনো ইটিপি স্থাপন করা হয়নি তার মধ্যে অধিকাংশই ছোট আকারের ডাইং ফ্যাক্টরি বলে জানা গেছে।

এদিকে ক্রোনি গ্রুপের বিরুদ্ধে ফতুল্লার কাশিপুরে হাটখোলা-গোগনগর ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় শীতলক্ষ্যা-ধলেশ্বরী নদীর সংযোগ খালের ৯ হাজার বর্গফুট ভরাট করে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। খালের দখল ও ভরাট করা অংশ সরিয়ে নিতে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জেলা অফিস থেকে একাধিকবার নোটিশ দিলেও তাতে কর্ণপাত করেনি শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। বরং দখলকৃত স্থানে এবার ভবন নির্মাণ করে ফেলেছে। নোটিশ পাঠানোর জের ধরে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাকে হুমকি দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে সাহস পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে নদী দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ক্রোনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি আসলাম সানি।

এদিকে এলাকাবাসীর অভিযোগ কাশিপুর দেওয়ানবাড়ী-ভোলাইল খালটিতে বসতবাড়ীর আবর্জনা আর শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে খালের পানি এতটাই দুষিত হয়ে গেছে যে, সেখানে ক্ষনিকের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলে দুর্গন্ধ আর মশার কামড়ে যেকোন সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর এই খাল দিয়ে এক সময় চলাচল করতো মালবাহী বড় বড় নৌযান, পাওয়া যেত সুস্বাদু মাছ। জাল ফেললেই উঠতো ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ। এই মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো জেলেরা। খালকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল জেলে সম্প্রদায়ের বাসস্থান। কিন্তু এখন স্থানীয়দের দখলদারিত্বে হারিয়ে গেছে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী কাশীপুর, ভোলাইল, দেওয়ানবাড়ীর খাল। এছাড়াও পঞ্চবটি, দেলপাড়া, ওয়াবদারপুল, বন্দর, সোনারগাঁ, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলার খাল দখল করে স্থাপনা নির্মান করে রেখেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় পানি নিষ্কাশনের একটি খাল ভরাট ও দখল করে বাঁশের পাইলিং দিয়ে মাছ চাষ করার অভিযোগ ওঠেছে স্থানীয় লোকজনদের বিরুদ্ধে। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও উপজেলা প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে স্থানীয় লোকজন এভাবে মাছ চাষ করছে। এতে করে খালটি স্থানীয় এলাকাবাসী রবিশষ্য চাষ ব্যাহত হওয়াসহ জনগণের ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও মেঘনা এ তিন নদীর মোহনা থেকে বন্দরের মাহমুদনগর পর্যন্ত খালটি ৫ থেকে ৬ কিলোমিটর দীর্ঘ। এ খালটি দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকার কৃষিকাজ, গোসল করাসহ রান্নার ও ঘরের কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে গত কয়েকবছর ধরে এ ৫ কিলোমিটার লম্বা খালের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ছোট-বড় বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। ফলে খালটিতে পানির প্রবাহ না থাকায় ধীরে ধীরে খালের পানি নোংরা ও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। যাতে করে স্থানীয় এলাকাবাসী এ খালের পানি ব্যবহার করতে পারছেন না।

সোনারগাঁ পৌরসভার ষোলপাড়ার সরকারি খাল ও জমি দখল করে এক ব্যক্তি সেতু নির্মাণ করছেন।২০০ বছরের পুরোনো ষোলপাড়া সরকারি খাল ও এর দুই পাশ ভরাট করে একটি সেতু নির্মাণ করছেন স্থানীয় বাবুল হোসেন। তিনি নিজের বাগানবাড়িতে আসা-যাওয়ার জন্য এ সেতু নির্মাণ করছেন। সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি খালপাড়ের মসজিদের অজুখানা ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র করছেন। খালটি দখল হলে এলাকার মানুষের বাড়িঘরে জমে থাকা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হতে পারবে না। মানুষ দুর্ভোগের শিকার হবেন।
 

নারায়ণগঞ্জ পোস্ট