ফাইল ছবি
নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের দুই বছর পরেও মামলার কোনো অগ্রগতি না দেখে হতাশ স্বজন হারানো মানুষেরা এখন বিচারের আশা ছেড়েই দিয়েছেন।
দুই বছর আগে রাতে নামাজ আদায় করতে গিয়ে ৩৩ জনের সঙ্গে প্রাণ হারানো শাহাদাত হোসেন সিফাতের মা মঞ্জু বেগম কষ্ট আর হাহাকার নিয়েই বলেন, “সরকার বাদী হইয়া মামলা করছে। আসামিও সরকারি লোক। আমাগো শোক আছে, থাকবো কিন্তু কপালে বিচার নাই। এইডা আশাও করি না”
একই ধরনের হতাশার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শুনিয়েছেন বাবা হারানো সন্তান, ছেলে হারানো বাবা, স্বামী হারানো স্ত্রীসহ শোকগ্রস্ত অনেকে।
অন্যান্য দিনের মতোই ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে ওই মসজিদে নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলেন পশ্চিম তল্লা এলাকাবাসী। নামাজ চলাকালে রাত সাড়ে ৮টার দিকে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। মসজিদে দুটি ফেইজ থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। অন্য একটি ফেইজ থেকে বিদ্যুৎ চালু করা হয়। এর মধ্যেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে, কেঁপে উঠে গোটা এলাকা।
ধোঁয়ার আবরণ সরে যাওয়ার পর মানুষ গিয়ে দেখতে পায়, মসজিদ এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। রক্তে ভেসে গেছে মেঝে, তার মধ্যে কাতরাচ্ছে অসহায় মানুষ।
পাইপ লাইনের ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হওয়ার পর সেদিন বিস্ফোরণে ৩৭ জন দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে এক শিশু ও মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদকসহ ৩৪ জনের মারা যান। অন্য তিনজন রাজধানী ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেন।
ঘটনার পরদিন ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ তিতাস, ডিপিডিসি, মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে ‘অবহেলাজনিত মুত্যু সংঘটনের’ অভিযোগ এনে মামলা করে, যার তদন্তভার পরে সিআইডির হাতে যায়। একই বছর সিআইডি মসজিদ কমিটির সভাপতিসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়, তারা সবাই জামিনে রয়েছেন। এই বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় মামলার বিচারকাজ শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ এবং হতাশা দেখা দিয়েছে নিহতের পরিবারগুলোয়।
শাহাদাত হোসেন সিফাত ছিলেন পরিবারের মেঝ ছেলে। এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। দরিদ্র পরিবারের সন্তান পরিবারের সঙ্গে পশ্চিম তল্লাতেই থাকতেন। মসজিদের বিস্ফোরণের পর গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্ল্যাস্টিক সার্জারি ইউনিটে।
সিফাত মাধ্যমিক পাস করে নারায়ণগঞ্জের কদম রসুল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল বলে জানান মা মঞ্জু বেগম। হাসপাতালে যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় বারবার কলেজে ভর্তি নিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করত সিফাত।
‘আব্বু ভর্তির ডেট তো শ্যাষ’ সিফাতের এই কথার উত্তরে বাবার সান্তনা দিয়ে বলতেন, “কলেজে কথা হয়েছে যে কোনো সময় ভর্তি করানো যাবে।“
টানা ১৮ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২২ সেপ্টেম্বর ২০ বছর বয়সী সিফাতের মৃত্যু হয় জানিয়ে মঞ্জু বেগম বলেন, “আমি আমার সোনার চান হারাইছি। এই শোক আমার জনম ভইরা থাকবো। আইজকা ২৪ মাস। তারপরও খাইতে গেলে, হুইতে গেলে মনে পড়ে সন্তানের কথা। খুবই ভদ্র ছিল আমার সিফাত।
“পোলায় আমারে আদর কইরা ‘মাদার’ বইলা ডাকতো। কত শখ ছিল কলেজে যাইবো, আনন্দ করবো! সেইডা আমি দেখতে পারলাম না। আমার মতো পোড়া কপাল আর কার আছে?”
এ ঘটনার বিচার প্রসঙ্গে মঞ্জু বেগম বলেন, “মসজিদে এই দুর্ঘটনাটা ঘটলো কেউ তো কিছু করলো না। আমরা গরিব মানুষ, পিছে পিছে তো ঘুরতে পারমু না। বিচার আর কারতে চামু?”
সিফাতের মায়ের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। আশাপাশের বাড়ি থেকে আসা প্রতিবেশীরাও সেই দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করে জানান দগ্ধদের চিৎকার এখনও তাদের কানে ভাসে।
সিফাতের বাবা ডেকোরেটর শ্রমিক মো. স্বপন বলেন, “আমার সন্তান গ্যাছে। কেউ তো আর খোঁজখবরও লয় না। সরকার-বাদী মামলা হইছে। যেই ৩৪ জন মারা গেছে তাদের কেউই মামলা করে নাই। আমরা মামলার খবরও জানি না। কার বিচার চাইমু, কার কাছে চাইমু?”
মসজিদে বিস্ফোরণের রাতেই দুই ছেলে সাব্বির (২২) ও জুবায়েরকে (১৮) একসঙ্গে হারান পারুল বিবি। তিনি জানান, বড় ছেলে সাব্বির নারায়ণগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন আর জুবায়ের সরকারি তোলারাম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পর জুবায়েরের পরীক্ষার ফল বের হয়। তবে ছোট ছেলে ইয়াসীন বিস্ফোরণের কিছু সময় আগে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যায়।
দুই ছেলে বেঁচে থাকতেই পারুর বিবির স্বামী নুরুদ্দিন আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র সংসার করছেন। এখন ছোট ছেলে ইয়াসিনকে (১০) নিয়ে এক রুমের ভাড়া বাসায় কোনোরকমে বেঁচে থাকার কথা জানান তিনি।
পারুল বিবি বলেন, “দুই ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। আমার স্বপ্ন আগুনে পুইড়া গেছে। কর্ম করার মতো কেউ নাই…। কয়েকটা বাচ্চাকে আরবি পড়িয়ে কোনোরকমে চলি। দুর্মূল্যের এই বাজারে অনেক কষ্ট হইয়া যায় সংসার চালাইতে।”
ঘটনার ভয়াবহতা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন ওই এলাকার বাসিন্দা সুমন। ওই রাতে সুমন তার ছেলে ও ৭০ বছর বয়সী বাবাকে নিয়ে এশায় নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন বাইতুস সালাত জামে মসজিদে। বিস্ফোরণে ছেলেকে নিয়ে সুমন বেঁচে গেলেও নিহত হন কারা বাবা কুদ্দুস বেপারী।
ঘটনার বর্ণনায় সুমন বলেন, “ফরজ ও সুন্নত নামাজ আদায় শেষে অনেকেই মসজিদের ভেতর বিতরের নামাজ পড়তেছিল। এই সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। বিদ্যুতের আরেকটা লাইন চালু করার পরপরই বিকট শব্দে হয় বিস্ফোরণ। আমি মসজিদের ভেতর থেকে বেরিয়ে ৩০-৪০ কদম দূরে যাওয়ার পরই এই বিস্ফোরণ ঘটে।
“দৌড়াইয়া আইসা দেখি মসজিদের সামনে রাস্তায় জমা পানির মধ্যে মানুষ গড়াগড়ি খাচ্ছে। ছেলেরে খুঁজবো নাকি বাবারে খুঁজবো বুঝে উঠতে পারতেছিলাম না। একটা মানুষের গায়েও কাপড় ছিল না। মসজিদের বাইরে ছেলেরে অক্ষত পাইলেও বাবারে পাই ভেতরে দগ্ধ অবস্থায়। রাতেই হাসপাতালে মারা যান তিনি।”
ওই বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন টানা দুই যুগ ধরে মসজিদে ইমামতি করে আসা মাওলানা আব্দুল মালেক। বিস্ফোরণের দুই বছর পর বর্তমান ইমাম তার ছেলে মুফতি ফাহিমুল ইসলাম জানান, ঘটনার রাতেও এশার নামাজে ইমামতি করেছেন বাবা। বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর তালিকায় প্রথম নামটিও তার।
ফাহিমুল ইসলাম বলেন, “মাথা থেকে বটগাছের ছায়া চইলা গেছে। ওই সময় আর পাবো না। এখন আল্লাহতায়ালা যেমনে চালাইতেছেন সেভাবে চলতেছি। আমরা তো তাও দুই ভাই আছি। বর্তমান বাজারে হিমশিম খাইতে হইলেও কোনোরকমে চলতাছি। কিন্তু অনেক পরিবারে উপার্জনক্ষম মানুষটাই নাই। তারা তো করুণ অবস্থাতে আছে। অনেকেই শহরে টিকতে না পাইরা গ্রামের বাড়িতে চইলা গেছে।”
বিস্ফোরণের পর এই মসজিদটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। পরে এলাকাবাসীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কার করে মসজিদটি ফের ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়। মসজিদ খুলে দেওয়ার পর দ্বিতীয় তলায় নামাজ হলেও চলতি বছরের রোজার মাসে সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার পর নিচতলাতেও নামাজ হচ্ছে বলেও জানান ইমাম ফাহিমুল ইসলাম।
এই ঘটনাকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বর্ণনা করে ফাহিমুল বলেন বলেন, “বিচারের আশা তো প্রথমেই আমরা ছেড়ে দিছি। মামলা হওয়ার পরে তিতাসকে ছাড় দিয়া দিলো। উল্টা মসজিদ কমিটি যারা আছে তাদেরকে হেনস্থা করা হচ্ছে। তারা কয়েকদিন পরপরই হাজিরা দিচ্ছেন। সরকার বাদী হয়ে মামলা করছে। সরকারেরই এইখানে আসলে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু করার দরকার ছিল। কিন্তু সরকার এখানে কিছু করছে বলে দেখছি না।“
তিতাসকেও দায়ী করে এই ইমাম বলেন, “গাফিলতি তিতাসের লোকজনের ছিল। কিন্তু তারা তো সরকারি কর্মকর্তা। তাদের গাফিলতির কথাই শুরু থেকে বলা হচ্ছে। তারপরও তাদেরকে মামলা থেকে বাদ দেওয়া হইছে। এরপর আর কি সুষ্ঠু বিচার আমরা পাবো?”
বিস্ফোরণের পর মসজিদের সামনের সড়ক খুঁড়ে গ্যাস লাইনের লিকেজ সারানো হলেও এলাকায় আরও বিভিন্ন স্থানে তিতাসের লাইনে ‘লিকেজ’ থেকে গেছে বলে অভিযোগ করেন ফাহিমুল।
তিনি বলেন, “এখনও রাস্তা দিয়ে গ্যাস উঠতে দেখি। তিতাস তাদের পাইপগুলোর লিকেজ এখনও সারাচ্ছে না…। এখনও অনেক জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ।”
মামলা:
ঘটনার পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ তিতাস, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এবং মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে ‘অবহেলাজনিত মুত্যু সংঘটনের’ অভিযোগ এনে মামলা করে, যার তদন্তভার পরে সিআইডির হাতে যায়। একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর সিআইডি মসজিদ কমিটির সভাপতিসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়, তারা সবাই জামিনে রয়েছেন।
সিআইডি তাদের অভিযোগপত্রে বলা হয়, “সঠিকভাবে মসজিদ পরিচলনায় কমিটির অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা, কারিগরি দিক বিবেচনা না করে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া, গ্যাসের উপস্থিতি জানার পরও তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা না নেওয়া, মসজিদের ভেতরে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি স্থাপন, তিতাসের কর্মীদের দায়িত্বে অবহেলা, গ্যাস লাইন তদারকি না করা, পাইপের ছিদ্র মেরামত না করা, ঝুঁকিপূর্ণভাবে গ্যাস লাইন স্থানান্তরের কারণে ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানি ঘটে বলে সিআইডির তদন্তে সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে।”
তবে অভিযোগপত্রে বাদ দেওয়া হয় তিতাসের গ্রেপ্তার হওয়া ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে পরবর্তীতে তাদের নাম অভিযোগপত্রে সম্পৃক্ত করা হবে বলে জানায় সিআইডি।
মামলাটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত থেকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছে বলে জানান আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান। তিনি জানান, ২৫ সেপ্টেম্বর এই মামলার তারিখ রয়েছে।“