প্রতীকী ছবি
দেশের জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার অংশ হিসেবে তিন মাস পরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সে হিসাবে চলতি বছরে আরও তিনবার দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমালেও বর্তমান ডলার মূল্য ও গ্রীষ্মের বর্ধিত বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে চালিত তেল বিদ্যুতের চড়া উৎপাদন ব্যয় সামগ্রিক ঘাটতি বাড়িয়ে দেবে, যা গ্রাহকের ওপর দ্বিগুণ চাপ তৈরি করবে। সে হিসাবে একটি ছোট পরিবারে এক বছরে বিদ্যুৎ বিল বাড়তে পারে ৬শ’ টাকা পর্যন্ত।
যদিও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন বছরে ১২ ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে উৎপাদন ব্যয়ের কাছাকাছি চলে আসবে এবং গ্রাহকের ওপর চাপ তৈরি হবে না। অন্যদিকে ভর্তুকিও প্রায় শূন্য হয়ে আসবে।
এদিকে দেশের বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ক্যাপাসিটি চার্জ। বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট এবং প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন মূল্য প্রায় ৮ টাকা। কিন্তু জ্বালানির উচ্চ মূল্যে ও ডলারের দামের কারণে যা বেড়ে ৯ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও ঘাটতি বৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি সে হারে কমবে না। বরং ভর্তুকির বাড়তি অর্থের সঙ্গে চড়া মূল্যে জ্বালানির দাম যুক্ত হবে। যা গ্রাহকের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেবে।
এদিকে গত মার্চে এক বছরের ব্যবধানে মার্চে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে সাড়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। নতুন দর অনুসারে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে বেড়েছে ৭০ পয়সা। নতুন দামে আবাসিক পর্যায়ে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য বেড়েছে ইউনিটপ্রতি ২৮ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ৩৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৬৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে এক মাসে বিল বাড়বে ২২ টাকা। পরে ধাপে ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৮৫ পয়সা।
তাতে এক মাসে বাড়তে পারে ৪০ টাকা। তৃতীয় ধাপে ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী (দেশে সবেচেয়ে বেশি আবাসিক গ্রাহক এই পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে) যাদের একাধিক বাতি, ফ্যান ও ফ্রিজ ব্যবহার করছেন তাদের ১২২ টাকা বিল বাড়তে পারে।
এই হিসাবে বছরে চারবার বিদ্যুৎ বিল বাড়ানো হলে তৃতীয় ধাপের বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর বছরে প্রায় ৬শ’ টাকা পর্যন্ত বিদ্যুৎ খরচ বাড়তে পারে এবং তিন বছরের। যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়াও গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল রিচার্চে প্রতি মাসে মিটার ভাড়া ও ট্যাক্স বাবদ গুনতে হচ্ছে প্রায় ২শ’-৩শ’ টাকা।
এ অবস্থায় নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু এই হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে কেবল গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোর যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে তা অনেকটাই অসম্ভব বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বেশ কয়েক বছর ধরেই আমদানিকৃত জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী। ফলে ক্রমাগত বাড়ছে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়। ফলে প্রতি তিন মাস পর পর দাম বৃদ্ধি করে ভর্তুতি কমানো হলেও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ঘাটতি থেকেই যাবে। এতে গ্রাহকের ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়লেও ভর্তুকি কমানো চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে দেশের বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা এ খাতে বাড়তি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সম্প্রতি বাজারে ডলারের দাম এক লাফে ৭ টাকা বেড়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত সব ধরনের জ্বালানি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। এছাড়াও গরমে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বৃদ্ধি পাওয়া বিকল্প হিসেবে তেলচালিত বিদ্যুতের উৎপাদন প্রায় ৪ গুণ বাড়ানো হয়েছে। যা কয়লা কিংবা আমদানিকৃত গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে। যা গড় উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। জ্বালানি বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শামসুল আলম যায়যায়দিনকে বলেন, সরকার তিন বছরে ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা করছে তাতে গ্রাহকের ওপর কেবল চাপই বাড়বে। অন্যদিকে আমদানি কমিয়ে যে ব্যয় সংকোচনের বর্তমান প্রবণতা সরকারের এ খাতে ভ্যাট ট্যাক্সসহ সামগ্রিক আয় কমিয়ে দেবে।
শামসুল আলম বলেন, ‘এ খাতে অন্যায়-অযুক্তিক ব্যয় বাড়ানো হলে ঘাটতির পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। এই বিপুল পরিমাণ ঘাটতি গ্রাহকেরে ওপর চাপিয়ে না দিয়ে নীতি সংস্কারের প্রয়োজন। আমরা সরকারের কাছে ১৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছি। যা গ্রহণ করা হলে গ্রাহকের ওপর বিলের বোঝা না বাড়িয়ে ব্যয় কমানো যাবে।’ এদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকদের পাওনা দুই বছর ধরে পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া পড়েছে। বছরে লোকসান ছাড়িয়ে গেছে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো। পরিস্থিতি উত্তরণে বন্ড ইস্যু করেও কোনো সমাধান মিলছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসবই হচ্ছে চাহিদার চেয়ে বেশি ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য। বাড়তি ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। তবু নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে। পুরনো কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ছে। নতুন আরও প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
সূত্র: যায় যায় দিন।