শনিবার, ২৯ মার্চ ২০২৫

|

চৈত্র ১৪ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

‘আল্লাহ হামার ছলক ফিরাইয়া দ্যাও’ : শহীদ রাসেলের বাবার আর্তনাদ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১২:২১, ২৫ মার্চ ২০২৫

‘আল্লাহ হামার ছলক ফিরাইয়া দ্যাও’ : শহীদ রাসেলের বাবার আর্তনাদ

ফাইল ছবি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডের দেওভোগ মার্কেটের ২ নম্বর গেটের সামনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন ১৮ বছর বয়সী রাসেল। তার বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কশব ইউনিয়নের ভোলাগাড়ী গ্রামে।

বাঁশ-খড়ের বেড়া আর টিনের ছাউনির ছোট্ট একটি বাড়ি রাসেলের। বাবা পিন্টু রহমান দিনমজুরি করে সংসার চালান। চার ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল সবার ছোট। তার এক বোন মানসিক প্রতিবন্ধী। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য রাসেল কাজ করছিলেন নারায়ণগঞ্জের একটি তৈরি পোশাক কারখানায়।

সন্তান হারানোর শোকে বিহ্বল শহীদ রাসেলের বাবা এখনও আর্তনাদ করেন, ‘ওরা হামার ছলের বুকোত গুলি মারলো ক্যা? আল্লাহ হামার ছলক ফিরাইয়া দ্যাও।’

গুলিবিদ্ধ রাসেল, হাসপাতালে লড়াই
১৯ জুলাই দুপুরে সংঘর্ষের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার বুকে একটি বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল। ২১ জুলাই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বুলেট বের করা হলেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। ২২ জুলাই রাতে তিনি মারা যান। পরদিন ২৩ জুলাই সকালে গ্রামের বাড়িতে লাশ পৌঁছায় এবং ওই দিনই দাফন সম্পন্ন হয়।

মায়ের আর্তনাদ
শহীদ রাসেলের মা অঞ্জনা বাসসকে বলেন, ‘শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেল ৫টার দিকে ছেলের সঙ্গে হামার শেষ কতা হইছিল। মা ও বোনেরা ক্যামন অ্যাচে, এগুলা খোঁজ নিলো। ওইদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাসেলের ফোন থ্যাকে কল আসে। কল ধরার পর অন্য এক লোক কলো, 'রাসেলের বুকত গুলি লাগিছে'।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এর মধ্যে শুনি কারফু জারি হয়া গ্যাছে। ঢাকাত যাওয়ার কোনো গাড়ি না পাওয়ায় আর য্যাতে পারিনি। পাড়ার লোকেরা হামাক ছোলক আসেলের মা কয়া ডাকতো। একন হামার ছল তো আর নাই, হামিও নাই।’

‘আন্দোলনে যায়নি, তবু গুলি খেল’
শহীদ রাসেলের বাবা পিন্টু রহমান তার ছেলে ‘আন্দোলনে যায়নি, তবু গুলি খেল’ উল্লেখ করে বাসসকে বলেন, ‘চারদিন ধরে হাসপাতালের বেডে কষ্টে কাতরাইছে। মৃত্যুর মুখোমুখি হওছে জ্যানেও ছেলের পাশে থাকতে পারিনি। কতই না কষ্ট প্যায়ে মারা গেছে হামার ছল। কতই না আর্তনাদ করিছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অভাবের সংসারে হামি কোনো ছলক স্কুলে দিতে পারিনি। হামার ছল আন্দোলন করেনি, মিছিলে যায়নি, তারপরেও হামার ছলক ম্যারে ফেলিছে বুকত গুলি করে। হামি একন কি খাম? ক্যাংকে চলমো? হামার ছল মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়োছে জ্যানেও তার পাশে থাকতে পারিনি। একটা মা-বাবার জন্য এর চ্যায়ে চরম কষ্ট আর কী হতে পারে?’

তিনি বলেন, ‘গুলি লাগিছে শুক্রবার। চারদিন ধরে হাসপাতালের বেডে কাঁতরাইছে। কতই না কষ্ট প্যায়ে মারা গেছে। কতই না আর্তনাদ করিছে। এমন কষ্ট য্যান আল্লাহ আর কাউকে না দেয়।’

সংসারের একমাত্র ভরসা
রাসেলের পরিবার অন্যের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করে। তার বাবা পিন্টু রহমান মানুষের জমিতে কাজ করে সংসার চালান। ছেলের পাঠানো টাকায় অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা চলত। প্রতিবেশীরা জানান, টাকার অভাবে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাতে পারেননি পিন্টু। রাসেলই ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা।

রাসেলের চাচা আব্দুর রশিদ বলেন, ‘রাসেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শোনার পর থেকেই তার মা মুখে কোনো দানাপানি নিচ্ছিল না। না খেয়ে খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার বাবা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। এখন কিছুটা সুস্থ হলেও ছেলের কথা মনে পড়লে হাউমাউ করে কাঁদে।’

আব্দুর রশিদ আরও বলেন, ‘সংসারের অভাবের কারণে রাসেল ক্লাস টু-থ্রি পর্যন্ত পড়ার পর আর স্কুলে যায়নি। গত দেড় বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের আখেড়া এলাকায় একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ৭-৮ হাজার টাকা বেতনে কাজ করছিল রাসেল। কুরবানির ঈদের ছুটি শেষে ১২-১৩ দিন আগে নারায়ণগঞ্জে ফিরে যায়। আর এখন সে বাড়িতে ফিরল লাশ হয়ে।’

সহায়তার আহ্বান
মান্দা উপজেলার কশব ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য ও প্রতিবেশী পাঞ্জব আলী বলেন, ‘রাসেলের বাবা খুবই গরীব। দিনমজুরি করে কোনো রকমে সংসার চালাত। তিন মেয়ের মধ্যে একটা প্রতিবন্ধী। এক মেয়ে বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু পরে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়। এখন সে বাবার বাড়িতেই থাকে।

ছেলেটা গার্মেন্টসে দেড় বছর ধরে কাজ শিখছিল। ৭-৮ হাজার টাকা বেতনে কোনোরকমে চলত। আর কিছুদিন গেলে হয়ত বেতন আরও বাড়ত, তখন হয়ত সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা ফিরত। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। পরিবারটিকে আর্থিক সহায়তা দিতে সরকারসহ বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।’

নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘ইতোমধ্যে সরকারিভাবে ২ লাখ টাকা শহীদ রাসেলের পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। আরও সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।’

সূত্র: বাসস।