
ফাইল ছবি
সুলতানি-মুঘল আমলের ঐতিহ্যকে ধারণ করে ঢাকার রাজপথে ঈদের আনন্দ মিছিল হয়েছে। ঈদকে আরও উৎসবমুখর করতে এই মিছিলের আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
সেখানে দেখা মিলেছে হাতি-ঘোড়া ও আলাদিনের চেরাগের জ্বিনসহ নানান ধরনের পাপেট।
এসব পাপেটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় গাধার পিঠে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার বসে থাকা পাপেট। সেই পাপেটের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ভাইরাল। নাসিরুদ্দিন হোজ্জা সম্পর্কে অজ্ঞরা সেই পাপেটের সঙ্গে অনেকের চেহারার মিল খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। কারও প্রশ্ন, গাধার পিঠেই বা কেন আর এভাবে উল্টোভাবে বসানো কেন পাপেটটিকে!
গোফবিহীন ও সফেদ দাড়ি-টুপির কারণে পাপেটটি দেখতে অনেকটা জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের মতো বলে মন্তব্য অনেকের। প্রশ্ন উঠেছে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার বসে থাকার সঙ্গে ঈদের সংস্কৃতির মিল কোথায়?
সবমিলিয়ে ঈদের দিন থেকেই পাপেটটি নিয়ে নানান মন্তব্য ও হাস্যরসে মেতেছেন নেটিজেনদের কেউ কেউ।
এ বিষয়ে পাপেটের শিল্পী ও মিছিলের আয়োজকরা বিবিসিকে বলেছেন, পাপেটটিতে বিজ্ঞ দার্শনিক নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। নাসিরুদ্দিন হোজ্জা ও জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান একই ব্যক্তিত্বের লোক না। যারা হোজ্জাকে পড়েননি তারা এমন মন্তব্য করছেন। মূলত বাংলা সাহিত্য ও মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস- ঐতিহ্যকে তুলে ধরতেই আয়োজনে ‘হোজ্জা’ চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ওই পাপেটে।
মূলত শিশুদের বিনোদনের উদ্দেশ্যেই এমন সব পাপেট বানানো হয়েছে বলে জানান তারা।
পাপেটের মূল শিল্পী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক জাহিদুল হক। জামায়াতের আমিরের মুখাবয়বের সঙ্গে মিলে যাওয়াকে কাকতালীয় বললেন তিনি।
অধ্যাপক জাহিদুল হক বলেন, নাসিরুদ্দিন হোজ্জার পাপেট ক্যারেক্টরটি বানানোর জন্য ছবিটি নেওয়া হয়েছিল একটি আরবি বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে। প্রচ্ছদের সঙ্গে নির্মিত ওই পাপেটটির চেহারার অনেক মিল রয়েছে। হয়তো এখানে পোশাকের কারণে এক ধরনের মিল পাওয়া গেছে। তবে এটা কাকতালীয়।
তিনি বলেন, জামায়াত আমিরের সঙ্গে কিছু মিল পাওয়া গেলেও, সেটি যে ইচ্ছাকৃতভাবে ওনাকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে, বিষয়টি একদমই এমন না। একই রকম মনে হলেও বা কাউকে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতো লাগলেও, সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক আলোচনার সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, শুধুই বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। এখানে বার্তা দেওয়ার কোনো বিষয় ছিল না।
আয়োজক ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, বাংলা সাহিত্যেও নাসিরুদ্দিন হোজ্জা চরিত্র এসেছে। এটা একটি মেটাফোরিক কারেক্টর। বাচ্চারা এসব পছন্দ করে। যে কারণে এটাকে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বিষয়টি ইতিবাচক। এখানে সমালোচনার সুযোগ নেই।
কে এই নাসিরুদ্দিন হোজ্জা, গাধার পিঠে কেন উল্টো দিকে মুখ করে বসে তিনি?
নাসিরুদ্দিন হোজ্জার নাম শোনেননি এমন মানুষ হয়ত বিরল। মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের কিছু অংশে তিনি একজন বিখ্যাত লোকচরিত্র। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লাখ লাখ শিশু নাসিরুদ্দিন হোজ্জার বুদ্ধির গল্প ও কৌতুক শুনে বড় হয়েছে। হোজ্জা ছিলেন একইসাথে একজন জ্ঞানী ও সহজ-সরল মানুষ। নিজের বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও সাধারণ জ্ঞান দিয়ে যেকোনো নাজুক পরিস্থিতি খুব সহজেই সামাল দেওয়ায় তার বেশ নাম ছিল। তার উপস্থিত বুদ্ধি ও বিজ্ঞতার খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে দেশ-দেশান্তরে।
ধারণা করা হয়, নাসিরুদ্দিন হোজ্জার জন্ম তুরস্কের সিবরিহিসারের হোর্তু গ্রামে, ১২০৮ সালে। পরে তিনি সেখান থেকে পরে কোনিয়ায় চলে যান। সেখানেই ১২৮৪ সালে তিনি মারা যান।
তবে কেউ কেউ বলেন, নাসিরুদ্দিন হোজ্জা নামে আসলে বাস্তবে কেউ ছিলেন না। এটি কেবল ১৩শ শতকে আনাতোলিয়ার আদিবাসীদের দ্বারা সৃষ্ট একটি কাল্পনিক চরিত্র।
তুরস্ক ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগেই দেখা যায়, নাসিরুদ্দিন হোজ্জা গাধার পিঠে উল্টো দিক হয়ে বসে আছেন।