ফাইল ছবি
প্রথম আলোঃ আবারও একটি ‘উপভোগ্য’ লড়াই দেখল গোটা দেশ। টানা কয়েক দিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ও বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ চলল। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে দেশের প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা চলতেই থাকল; বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চুপটি মেরে থাকল, পুলিশ-প্রশাসনও। অজস্র ফেসবুক লাইভ, সংবাদমাধ্যমের লাইভে সেই সংঘর্ষ সবাই দেখল।
গত এপ্রিলে নিউমার্কেট এলাকায় দোকান মালিক-কর্মচারী ও ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষও এমন ‘উপভোগ্য’ হয়ে উঠেছিল। যার করুণ পরিণতিতে দুজন নিরীহ তরুণকে প্রাণ হারাতেও হলো। এবারের সংঘর্ষে অন্তত কারও মায়ের বুক খালি হয়নি, সে কারণে দুই পক্ষকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
দুই পক্ষই বেপরোয়া থাকলেও মারটা বরাবরের মতোই খেয়েছে ছাত্রদল। উল্টো মামলা ও গ্রেপ্তারের শিকারও হয়েছে তারা। সেটিই স্বাভাবিক। তাদের মূল দল বিএনপি যদি ক্ষমতাসীন থাকত তাহলে নিয়ম অনুযায়ী মারটা খেত ছাত্রলীগ, জেলেও ঢুকতে হতো তাদের। বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝা খুব একটা জটিল নয়। নির্দিষ্ট ছকে ফেলে দিলেই হলো। তাতেই ‘রাজনৈতিক বোদ্ধা’ হয়ে যাওয়া যায় সহজে।
তো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ছাত্রদলের ওপর যেভাবে হামলে পড়ল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা, সেই কটূক্তি কী ছিল জানি না, কোথাও দেখলামও না। তবে এতে বরং ছাত্রলীগেরই লাভ হয়েছে, বিশেষ করে পদপ্রত্যাশী কিছু নেতা-কর্মীর ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে যদি কোনোভাবে ‘সহমত ভাই’ বা সহমত ভাইদের ‘বড় ভাইদের’ সুনজরে আসার এমন সুযোগ কি কেউ হেলায় হারাতে চায়! রীতিমতো ‘পাগলা ঘোড়া’ হয়ে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের পিটুনি দিতে টগবগ টগবগ করে ক্যাম্পাসে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন তাঁরা।
ছাত্রলীগের হাতে মার খেতে খেতে নেতা হয়ে ওঠা গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের বক্তব্যেই ‘পাগলা ঘোড়া’ কথাটা পেলাম। গত শনিবার পল্টনে এক বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আজ ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে পাগলা ঘোড়ার মতো বেপরোয়া ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা অন্য দল ও ভিন্নমতের নাগরিকদের ওপর হামলা করেছে। শুধু হামলাই করছে না, দেশের আদালত চত্বরকেও রক্তাক্ত করেছে।’ নুরুলের রাজনীতি নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নানা সমালোচনা আছে। তাঁকে আমার বা আপনার পছন্দ না–ও হতে পারে, তবে সে অন্য আলোচনা।
পাগলা ঘোড়া কথাটা শুনেই আমার তখন কুদ্দুস বয়াতির বিখ্যাত একটি গানের কথা মনে পড়ল। সেটি হলো—‘আমার পাগলা ঘোড়ারে...কই থাইকা কই লইয়া যাস?’ পাগলা ঘোড়ার চরিত্রই আসলে এমন—কই থেকে কই নিয়ে যায়, কই থেকে কই চলে যায়, কী না করে, কী না বলে, কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। যেমন সব ভিডিও ফুটেজেই দেখা যাচ্ছে ছাত্রদলকে কারা হামলা চালিয়েছে, ছাত্রলীগের কোন কোন নেতা-কর্মী লাঠি-বাঁশ-রড-পাইপ দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগ বলছে সেখানে নাকি কোনো হামলার ঘটনা হয়নি, প্রতিবাদ হয়েছে। এমনকি ছাত্রলীগও সেটি করেনি, করেছে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীরা’, আবার কখনোও বলছে, সেটি নাকি করেছে ‘প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা’।
শহীদুল্লাহ হলের নালার মধ্যে ফেলে ছাত্রদলের দুজনকে পেটাল ছাত্রলীগ। তাদেরকে আবার চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রিকশাতেও তুলে দিল তাঁরা। মাঝপথে আবার ছাত্রলীগই তাদেরকে রিকশা থেকে ফেলে দিল। ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে যেখানে পেয়েছে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। এমনকি রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় একাধিক যাত্রীকেও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীকে সন্দেহে মারা হয়েছে। এ না হলে ‘পাগলা ঘোড়া’! ছাত্রদলকে ‘প্রতিহত’ করতে ছাত্রলীগের এত এত গ্রুপ চারদিক থেকে হামলে পড়ল যে, ছাত্রদলের কর্মী মনে করে নিজেদের কর্মীদেরও পিটিয়েছে তারা। গোটা ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোর একাধিক প্রতিবেদনে বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
ছাত্রলীগের দৌড়ানি খেয়ে সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে ঢুকে পড়েও রক্ষা পায়নি ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। একজনকে তো সবাই মিলে যেভাবে লাঠিপেটা করল, তাতে যে সে প্রাণে রক্ষা পেয়েছে, সেটিই অবাক করার মতো। সেই পিটুনিতে আমরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেত্রীকেও দেখলাম। গোটা হামলাতে তিনি বেশ ‘সাহসী’ ভূমিকাই পালন করেন। সুপ্রিম কোর্টে পড়ে থাকা ছাত্রদল কর্মীর ওপর তার লাঠিপেটার ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়লে বেশ সমালোচনারও শিকার হন তিনি। আবার সেই নেত্রীর ‘আহত অবস্থায়’ হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ট্রল হতে দেখলাম আমরা। আবার ছাত্রদলের এক নেত্রীকে রাস্তায় ফেলে ভয়াবহভাবে মারার সময় এক ছাত্রলীগ নেতার প্রশংসনীয় ভূমিকাও আমরা দেখেছি। এক ছাত্রলীগ কর্মী ওই নারীকে লাঠিপেটা করতে গেলে নেতার হাতে উল্টো লাঠির বাড়ি খেতে হয়েছে তাঁকে।
এ দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ দেশের তরুণ সমাজকে ‘আদর-সোহাগ’ করে পায়ে শিকল পরিয়ে যেমনে ইচ্ছা ব্যবহার করার দিন কবে শেষ হবে, আমরা জানি না। ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়াল বাহিনী কিংবা পাগলা ঘোড়ার দল হওয়া থেকে আদৌ মুক্তি পাবে কি এ দেশের ছাত্ররা?
ছাত্রলীগের এমন শক্তি প্রদর্শনের পেছনে পদপ্রত্যাশীদের দলের ‘আদর্শ কর্মী’ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টার কথা সংবাদমাধ্যমগুলোতে উঠে এসেছে। যার কারণে সংবাদমাধ্যমে তাঁদের নাম এবং ছাত্রদলকে পেটানোতে ‘সাহসী ভূমিকা’র ঠিকঠাকভাবে না এলে কাউকে কাউকে উষ্মা প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। যার মধ্যে একজন সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগের এক নেতা ছাত্রদলের ওপর হামলার সময় বেশ আক্রমণাত্মক ছিলেন। সংবাদমাধ্যমে হামলার খবর আসার পর এক ইংরেজি দৈনিকের প্রতিনিধির কাছে তাঁর জিজ্ঞাসা ছিল, তিনি হামলার সময় ‘সক্রিয়’ থাকলেও কেন সংবাদ প্রতিবেদনে তাঁর নাম রাখা হয়নি। তিনি ওই সংবাদদাতাকে বলেন, ‘আপনি যদি হামলার বিষয়ে কোনো রিপোর্ট করেন, তাহলে অনুগ্রহ করে আমার নামও লিখুন। এতে আমি দলে আরও ভালো পোস্ট পাব।’ এতেও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়, কেন আমাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের ‘পাগলা ঘোড়া’ হতে হয়।
কয়েক দিনের এই পাল্টাপাল্টি হামলার খবর প্রকাশ নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর নাখোশ দেখলাম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল-নাহিয়ান খান। ছাত্রদলকে পিটিয়ে উল্টো ছাত্রদলকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেওয়া এক প্রতিবাদ সভাতে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আজকে সবাই আরামে আছেন তো, ঘুমাতে পারেন তো, এ জন্য অনেক কিছু ভুলে গেছেন। আপনারা মনে করে দেইখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করত ছাত্রদল।...ছাত্রলীগ গানে-গানে, কবিতার মাধ্যমে কথা বলতে পারে, আবার ছাত্রদলের গুন্ডাদের রাজপথেও মোকাবিলা করতে পারে। আমাদের খারাপ দিকগুলো নিয়ে সংবাদ করলে আমরা সাধুবাদ জানাব। কিন্তু তথাকথিত সুশীল হবেন না।’ তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে আরও বলেন, ‘গেস্টরুমকে বারবার টর্চার সেল বলে মিথ্যাচার করেন কেন আপনারা ছাত্রলীগকে ষড়যন্ত্র করেন? ছাত্রলীগ আছে বলেই আপনারা আরামে আছেন...।’ অথচ কে না জানে, তাদের কল্যাণে গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঐতিহ্যে’ পরিণত হয়েছে।
ভাবতেই ভালো লাগছে যে, ছাত্রলীগ আছে বলে সাংবাদিকেরা, সাধারণ শিক্ষার্থীরা, এ দেশের মানুষ ‘আরামে ঘুমাতে পারছে’! তাহলে এত বড় পুলিশ বাহিনীর কী প্রয়োজন? এতগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রেখে জনগণের টাকা কেন এভাবে নষ্ট করা হচ্ছে? চিন্তা করছি, দেশের শান্তি রক্ষার দায়িত্ব ‘পাগলা ঘোড়া’দের হাতে ছেড়ে দিলে কী অবস্থা না হয়!
ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের এই পাল্টাপাল্টি হামলা নিয়ে তাদের মূল দলের নেতারা রীতিমতো ‘উৎসাহ’ দিয়ে গেছেন। দীর্ঘদিন পরে ছাত্রদলের এমন ‘জেগে ওঠায়’ বিএনপি নেতাদেরও বেশ উজ্জীবিত মনে হলো। প্রতিবাদ সমাবেশ করে তাঁরা নিজেদের ছাত্রসংগঠনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক সভায় ছাত্রলীগের উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘গায়ের জোরে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আজকে তোমাদের ব্যবহার করছে। তোমাদের দানবে পরিণত করছে।’ কিন্তু বিএনপি যখন ‘কোনো এক কালে’ ক্ষমতায় ছিল, তখন তার দল কি ছাত্রদলকে ‘দানব’ বানায়নি? তখন নিশ্চয়ই ‘পাগলা ঘোড়া’ ছাত্রলীগ ছিল না।
আবার কুদ্দুস বয়াতির পাগলা ঘোড়ার গানটার কথা মনে পড়ে গেল—‘আদর-সোহাগ কইরা শিকল দিয়া আমার পায়ে...ডাইনে যাওয়ার কথা থাকলেও তুই নিয়া যাস বাঁয়ে।’ এ দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ দেশের তরুণ সমাজকে ‘আদর-সোহাগ’ করে পায়ে শিকল পরিয়ে যেমনে ইচ্ছা ব্যবহার করার দিন কবে শেষ হবে, আমরা জানি না। ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়াল বাহিনী কিংবা পাগলা ঘোড়ার দল হওয়া থেকে আদৌ মুক্তি পাবে কি এ দেশের ছাত্ররা?