রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

|

পৌষ ৭ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

বাংলা সালের ইতিকথা ও ফতেউল্লাহ সিরাজী এবং প্রচলিত কিছু বিভ্রান্তি 

মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ

প্রকাশিত: ১৩:৪৭, ১৫ এপ্রিল ২০২৩

বাংলা সালের ইতিকথা ও ফতেউল্লাহ সিরাজী এবং প্রচলিত কিছু বিভ্রান্তি 

ফাইল ছবি

স্বাগতম ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। বাংলা সনের জন্মকথার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে বাদশাহ আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তাঁর সভাসদ(ভূমি মন্ত্রী) জ্যোতিসর্বিদ আমির ফতেউল্লাহ শিরাজীর সহযোগিতায ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে নতুন এক বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন। তখন কৃষকদের কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়, যা পরে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সময়ে প্রচলিত রাজকীয় সন ছিল ‘হিজরি সন’, যা চন্দ্রসন হওয়ার প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতো না।

এ কারণে সম্রাট আকবর একটি সৌরভিত্তিক সন প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, যা কৃষকদের ফসল উৎপাদনের সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। নতুন এই সাল আকবরের রাজত্বের ২৯তম বর্ষে চালু হলেও তা গণনা আরম্ভ হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকেই, কারণ একই দিনেই দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে তিনি হিমুকে পরাজিত করেছিলেন।

ঘটনাক্রমে বাংলা সনের প্রবর্তক ও স¤্রাট আকবরের ভূমি মন্ত্রী জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ শিরাজী শেষ জীবনে বাংলায় চলে আসেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। ফতেউল্লাহ শিরাজীর ইন্তেকালের পরে তাকে ঢাকার অদূরে বুড়িগংগার পাড়ে সমাহিত করা হয়।এবং তার নামানুসারে অত্র অন্চলের নামকরণ করা হয়।যা বর্তমানে নারায়নগন্জ্ঞের ফতুল্লা থানা এলাকা।বর্তমানে ফতুল্লা মডেল থানার ঠিক পূর্ব দিকে অবস্থান হচ্ছে শাহ ফতেউল্লাহ সিরাজী মাজার শরীফ।উল্লেখ্য ভূমি পরিমাপে শিকল পদ্ধতির প্রবর্তকও আমির ফতেউল্লাহ শিরাজী।

প্রথমদিকে মাসের নাম ছিল ফারওয়ারদিন, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহরিয়ার, আবান, আযার, দে, বাহমান ইত্যাদি। পরে নাক্ষত্রিক নিয়মে বাংলা সনের মাসগুলোর নামকরণ করা হয়। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন এই নামগুলো নেওয়া হয়েছে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাকা জাতির রাজত্বের সময় প্রচলিত শাকাব্দ থেকে:

১. বিশাখা থেকে বৈশাখ। ২. জাইষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য। ৩. আষাঢ়া থেকে আষাঢ়। ৪. শ্রাবনা থেকে শ্রাবন। ৫. ভাদ্রপাদা থেকে ভাদ্র। ৬. আশ্বিনী থেকে আশ্বিন। ৭. কৃতিকা থেকে কার্তিক। ৮. পুস্যা থেকে পৌষ। ৯. আগ্রৈহনী থেকে আগ্রহায়ণ। ১০. মাঘা থেকে মাঘ। ১১. ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন। ১২. চিত্রা থেকে চৈত্র

‘তারিখ-এ-এলাহি’র আগে বাঙালিরা শকাব্দ অনুযায়ী চৈত্র মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ব্যবহার করত। পরে যখন ৯৬৩ হিজরির প্রথম মাস মহররমকে ‘তারিখ-এ-এলাহি’র প্রথম মাস ধরে গণনা করা শুরু হয় তখন তা বৈশাখ মাসের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় বৈশাখকেই ধরা হয় “তারিখ-এ-এলাহি”র প্রথম মাস।বাংলা সনের প্রথম বছর ছিল ৯৬৩ হিজরি। এর আগে কোনো বাংলা সন নেই।

১৬০৮ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীররে নির্দেশে সুবেদার ইসলাম খা চিশতি ঢাকাকে যখন রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন, তখন থেকেই রাজস্ব আদায় ও ব্যবসা বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য বাংলা বছরের পহেলা বৈশাখকে উৎসবের দিন হিসেবে পালন শুরু করেন।বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, সম্রাট আকবরের অনুকরণে বৈশাখের প্রথম দিন সুবেদার ইসলাম চিশতি তাঁর বাসভবনের সামনে সব প্রজার শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ এবং আনুষাঙ্গিক উৎসব পালন করতেন। সেখানে সমাজের সকল স্তরের মানুষ উপস্থিত থাকত। প্রজাদের খাজনা আদায় ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি চলত গান-বাজনা, গরু-মোষের লড়াই, কাবাডি খেলা ও হালখাতা অনুষ্ঠান।

প্রজারা নতুন জামাকাপড় পরে জমিদারবাড়ী খাজনা দিতে আসত। জমিদাররা আঙিনায় নেমে এসে প্রজাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ে করতেন। সবশেষে ভোজপর্ব দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হত।কালের পরিবর্তনে পহেলে বৈশাখ ‘খাজনা আদায়ে’র জন্য নির্ধারিত দিন থেকে বাঙালিদের নুতন বছরের পদার্পণের উৎসবের ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এরপর আবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালে, তখন তা ছিল ব্রিটিশবিরোধী চেতনার অংশ। তবে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ইতিহাসের কোথাও পান্তা ইলিশ বা মংগল শোভা যাত্রার কোন প্রমান পাওয়া যায় না। বর্ষবরণের কোন ইতিহাসও পাওয়া যায় না।

বাংলা সংস্কৃতির ওপর কালো থাবা বিস্তারে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ বা ১৯৬৫ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অয়োাজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট।মূলত ছায়ানটের অনুষ্ঠানটিই ব্যাপকতা পেয়ে আজ এ পর্যন্ত এসেছে।বর্ষবরণটি জাতিগত বা ঐতিহাসিক কোন উৎসব নয়,একান্তই ছায়ানটের একান্ত ইচ্ছা।অহিদুল হক ও সানজিদা খাতুন দম্পতির আবিস্কার হচ্ছে বর্তমানের বর্ষবরণ।

১৯৭২ সালের পর থেকেই এটি নিয়মিত উৎসব হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৮০ সালে এর সঙ্গে যোগ হয় চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা।প্রকৃত পক্ষে বাংলা সনের সাথে পান্তা ইলিশ, মঙ্গল শোভাযাত্রা বা রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে বর্ষ বরণ বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়।

তথ্য সূত্রঃ ‘ঐতিহ্য অন্বেষণ’–শারমিন রেজওয়ানা ও বাংলাপিডিয়া।