মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

|

অগ্রাহায়ণ ১৮ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

একটি ছাতা ও একটি গভীর সমুদ্র বন্দর

আবদুল্লাহ ইসহাক খান

প্রকাশিত: ২২:৫১, ৯ মে ২০২৩

একটি ছাতা ও একটি গভীর সমুদ্র বন্দর

ফাইল ছবি

ছাতা একটি প্রয়োজনীয় জিনিস এবং ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলের বাসায়ই এটি থাকে অন্তত একটি হলেও। বৃষ্টি হলে রাস্তা-ঘাটে ছাতার ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় এবং বৃষ্টি বেশীদিন দীর্ঘ হলে বাজারে ছাতার বিক্রিও অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ছাতা শুধু বৃষ্টিই নয় বরং অতিরিক্ত তাপ থেকেও মানুষকে রক্ষা করে। 

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো আমাদের দেশে অতিরিক্ত গরমের সময় এমনকি গ্রীষ্মেকালে যখন তাপমাত্রা অত্যাধিক রকম বৃদ্ধি পায়, অতিরিক্ত রোদের কারণে যখন ঘরের বাইরে বের হওয়া কষ্টকর হয়ে যায় তখনো রাস্তাঘাটে ছাতার ব্যবহার তেমন দেখা যায়না বা গ্রীষ্মকালে ছাতার বিক্রি কখনো বেড়ে গিয়েছে তেমনটাও শোনা যায়না। 

আমাদের এই অদ্ভুত আচরণের মাধ্যমে মূলত এটাই প্রমাণিত হয় যে কোনো পরিস্থিতিতে বাধ্য না হলে আমরা সাধারণত আমাদের রিসোর্সগুলো ব্যবহার করিনা বা বুদ্ধিদীপ্তভাবে ব্যবহার করতে পারিনা যেমন বৃষ্টি শুরু না হওয়া পর্যন্ত আমরা ছাতার ব্যবহার করিনা, যদিও সেটা সারাবছর ঘরের কোণেই পড়ে থাকে। অর্থাৎ আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে, পরিকল্পনা করে কোন রিসোর্সকে ব্যবহার করতে পারিনা বা সেই রির্সোসের উপযোগিতা বাড়াতে পারিনা যতক্ষণ না কেউ আমাদের সেই রিসোর্স ব্যবহার করতে বাধ্য না করে বা আমরা এমন পরিস্থিতীর স্বীকার না হই কেবল তখনই আমরা সেই রিসোর্স ব্যবহার করি। কিংবা অন্য কেউ আমাদের রিসোর্স নিয়ে ব্যবহারের পরিকল্পনা করার পরে তখন আমরা কেবল সেই রিসোর্সকে আমাদের সামনে খুঁজে পাই, তার আগ পর্যন্ত সেটা মনে হয় আমরা চোখেও দেখিনা এবং অন্যের বুদ্ধি শুনে তারপরে সেই রিসোর্স ব্যবহারে আমরা উদ্যোগী হই। 

আমাদের এই বৈশিষ্ট মূলত একটি চিন্তাহীন ও বুদ্ধিহীন সমাজের প্রতি দিকনির্দেশ করে যাদের নিজস্ব কোনো বুদ্ধি নেই, নিজস্ব কোন পরিকল্পনা বা চিন্তাভাবনা নেই তার আশেপাশের রিসোর্সকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে যতক্ষণ না তাকে বাধ্য করা হয় বা পরিস্থিতি তাকে সেভাবে বাধ্য করে বা অন্য কেউ বুদ্ধি দিলে তারপরে সে সেই রিসোর্স কাজে লাগানোর বিষয়ে উদ্যোগী হয়। 

ছাতা এখানে একটি সহজ উদাহরণ এবং এরকম অসংখ্য রিসোর্স আমাদের চারপাশে হরহামেশাই পড়ে থাকে যা আমরা ব্যবহার করিনা বা চোখে দেখেও দেখিনা শুধুমাত্র আমাদের চিন্তাহীনতা, বুদ্ধিহীনতা, সেই বিষয়ে পর্যাপ্ত পড়াশুনা ও গবেষণার অভাবে। যেমন আমরা ছোটবেলা থেকেই সবসময় শুনে আসছি যে জনসংখা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। অথচ বড় হয়ে দেখলাম বেশি জনসংখ্যার কারণে, সস্তাশ্রমের কারণে রেডিমেড গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি হয়ে গেলো বাংলাদেশের আয়উপার্জনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। অর্থাৎ এই বেশি জনসংখা ও সস্তা শ্রম যাকে আমাদের বিদ্যালয়ে, আমাদের সিলেবাসে সারাজীবন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হলো তা কার্যক্ষেত্রে আমাদের জন্য পরিণত হলো আয়-উপার্জনের সবচেয়ে বড় রির্সোসে।

কিন্তু এই বেশি জনসংখা নিয়ে, এই সস্তা শ্রম নিয়ে আমাদের নিজস্ব কোন পরিকল্পনা ছিলনা। বরং ঘটনাচক্রে আন্তর্জাতিক পোশাক বাজারের ডিমান্ড এন্ড সাপ্লাই চেইনের ধাক্কায় এই দেশে রেডিমেড গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি একটি বড় রপ্তানীর খাতে পরিণত হয়ে গেলো। ঠিক একই ব্যাপার ঘটলো বিদেশে সস্তা শ্রম রপ্তানির ক্ষেত্রেও। এখানেও নেই আমাদের নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা কিভাবে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে বিদেশে দক্ষ শ্রম রপ্তানি করা যায় এবং দেশে বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা যায়। বরং গ্রামের গরিব লোকজন নিজ জমিজমা বিক্রি করে যে যেভাবে পারছে বিদেশী ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী নিজের সস্তা শ্রম তাদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। 

এবার বহুল আলোচিত deep sea port মাতারবাড়ির দিকে যদি দৃষ্টিপাত করি তাহলে সেখানেও দেখতে পাই একইরকম চিন্তাহীনতার বিষয়।চিন্তাহীন একটি জাতি হিসেবে এবং একটি রাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূলে পলিসি making এ আমরা আসলেই কতোটা দুর্বল তা এখানে পরিষ্কার হয়ে যায়।

এই মাতারবাড়ী deep sea port এর অবস্থান ও সম্ভাব্যতা নির্ণয় জাপানের JAICA তাদের সাফল্য। কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের কাজে প্রয়োজনীয় জেটি নির্মাণের সময় তারা deep sea port এর জন্য সঠিক স্থান খুঁজে বের করে। অথচ তাদের প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য ছিলনা কোন deep sea port তৈরী করা। কিন্তু তারা যখন তাদের চোখ কান খোলা রেখে সম্ভাব্য রিসোর্স analysis করছিল তখন তারা দেখল এখানে deep sea port করার মতোন সাগরের যথেষ্ট গভীরতা আছে। 

অথচ এই বঙ্গোপসাগর, তার উপকূল, তার গভীরতা আমাদের কাছে গত পঞ্চাশ বছর ধরেই আছে। এই রিসোর্স এতদিন আমাদের নিজেদের কাছেই চরম অবহেলায় পড়ে ছিলো। তাহলে আমরা কেন উদ্যোগী হয়ে, নিজেরা গবেষণা করে সেই রিসোর্স jaica এর আগে চিহ্নিত করতে পারলামনা? তারমানে আমাদের সেই মেধা, যোগ্যতা, দূরদর্শিতা, দক্ষতা ও শিক্ষা নেই বা আসলে নেই সেই দক্ষতা অর্জনের ইচ্ছা বা নেই তার জন্য কোনো সঠিক পরিকল্পনা। 

আবার deep sea port তৈরী হয়ে যাবার আগেই ভারতের স্বার্থে ও জাপানের অর্থায়নে আমরা indo-pacific আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি BIG B initiative এর মাধ্যমে। যেখানে আমাদের deep sea project এর মাধ্যমে ভারতের landlock seven sisters এর সাতটি রাজ্যের জন্য আমদানী-রপ্তানির দুয়ার খুলে যাবে। এখানে পরিকল্পনা করছে ভারত তাদের নিজ স্বার্থের জন্য, অর্থায়ন করছে জাপান indo-pacific zone এ চীনের অধ্যিপত্য ঠেকানোর জন্য আর রিসোর্স ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের। আমাদের দেশের সমুদ্র, আমাদের বন্দর, আমাদের ট্রানজিট ও আমাদের লোনের কিস্তি এগুলোই হচ্ছে এই BIG B initiative এর মূল রিসোর্স। 

অর্থাৎ এখানেও আমাদের রিসোর্স নিয়ে আমাদের নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা নেই, নিজস্ব কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। বরং আমরা কেবল তখনই আমাদের রিসোর্স ব্যবহার করতে পারছি যখন আমাদের রিসোর্স নিয়ে অন্য কেউ পরিকল্পনা করছে আর আমরা কেবল তার পরিকল্পনার সহযোগী হচ্ছি সেই গ্রামের মূর্খ শ্রমিকের মতোন যে নিজের জমিজমা বিক্রি করে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে তার সস্তা শ্রম বিক্রি করছে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী। যা আবারো একটি বুদ্ধিহীন ও চিন্তাহীন জাতির নির্দেশক। আমাদের রিসোর্স নিয়ে যদি অন্য কেউ পরিকল্পনা করে তাহলে সে নিশ্চয় তার নিজ স্বার্থের অনুকূলেই পরিকল্পনা করবে এটুকু বুঝার জন্য নিশ্চয় অনেক বেশী জ্ঞান-বুদ্ধি রাখার প্রয়োজন পড়েনা।