
প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে প্রধান বাধা সরকারি সেবার মান, ইউটিলিটি সেবার অপ্রতুলতা, দুর্নীতি এবং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোর বোঝাপড়ায় ঘাটতি। তা ছাড়া বিনিয়োগকারীরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতার আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে যখন বিনিয়োগে নামেন তখন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, সরকারের নিম্নস্তরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত সহযোগিতা পান না।
ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলনে আসা বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন শেষে সরকারের দায়িত্বশীলদের এমন পর্যবেক্ষণ জানিয়েছেন। এসব বাধা কীভাবে সরকার সমাধান করবে, তার উত্তর চেয়েছেন তারা। এ ছাড়া বিনিয়োগ করলে সরকার তাদের কী সুবিধা দেবে, তাও জানতে চেয়েছেন।
বিনিয়োগ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। তিনি জানান, প্রথম দুই দিনে সফররত বিনিয়োগকারীদের ইতিবাচক মনোভাব প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। আজ বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিনিয়োগ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান জানান, সফররত বিনিয়োগকারীরা সোমবার চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড এবং মিরসরাইয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। মঙ্গলবার তারা গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে। যারা অবিলম্বে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চান, তারা এই অঞ্চল দেখে খুবই খুশি হয়েছেন। একটি সুইডিশ কোম্পানি জমি নিতে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
তিনি আরও জানান, কোরিয়ার ৩০ জনের বিনিয়োগকারী দলের কেউ কেউ আগেও এসেছিলেন, কিন্তু বিনিয়োগ করেননি। এবার তারা খুবই ভালো ধারণা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে টেক্সটাইল, ওষুধ, ডিজিটাল ইকোনমি, লজিস্টিকসসহ নানা খাতের বড় বিনিয়োগকারী রয়েছেন। তাদের কারও কারও ৮ থেকে ১০টি দেশে কারখানা আছে।
চীনের প্রতিনিধি দল প্রধান উপেদষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানিয়েছে, তাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিনিয়োগে সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হলেও সরকারের নিচের দিকের কর্মকর্তারা প্রতিশ্রুতি রাখেননি। এমনও হয়েছে একটি কোম্পানি সাড়ে তিন বছরের জন্য একটি লাইসেন্স নিতে না পেরে কোম্পানি চালু করতে পারছে না। তাদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বিনিয়োগে যেসব বাধার কথা বিদেশিরা বলেছেন, তা সরকার কীভাবে এবং কতদিনে সমাধান করবে– এমন প্রশ্নে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, সব সমস্যার সমাধান হবে না, আশা করাও ঠিক নয়। যেসব বিষয়ে বেশি উদ্বেগ, তেমন ২০টি সুনির্দিষ্ট বিষয় বিডা আগেই চিহ্নিত করেছে এবং তা চলতি বছরের মধ্যে সমাধানের পরিকল্পনা নিয়ে এরই মধ্যে কাজ চলছে। তিনি বলেন. ‘সব দেশেই বিনিয়োগে কিছু সমস্যা আছে, আমাদেরও আছে। আমরা বিনিয়োগকারীদের বলছি, আপনারা বিনিয়োগে আসুন, আপনারা কী চান, তা আমাদের জানান।’
বিনিয়োগ সম্মেলনকে সরকার ও সরকারি সেবাপ্রদানকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নেটওয়ার্কিং সম্মেলন বলে মন্তব্য করেন আশিক চৌধুরী। তিনি বলেন, সম্মেলনের চতুর্থ দিনে বিডার কার্যালয়ে সরকারের এমন সব দপ্তরের কর্মকর্তারা থাকবেন, যেখানে তারা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেসব সেবা চাইবেন, তা কীভাবে নিশ্চিত করবেন তা জানাবেন।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জ্বালানি নিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের অন্যতম প্রধান দুই উদ্বেগের বিষয়। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের পর যেসব রাজনৈতিক দলের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেসব দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তারা বৈঠক করবেন। বর্তমান সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তা তখনও বলবৎ থাকবে কিনা, সে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি বা মনোভাব জানবেন।
এ বছরের বিনিয়োগ সম্মেলন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আনার নিশ্চয়তা নেওয়া ও ঘোষণা দেওয়া নয়– মন্তব্য করে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পেলাম, এমন ঘোষণা দিতে এ সম্মেলন করছি না। চাইলে এমন গল্প আমরা প্রচার করতে পারি; কিন্তু ইচ্ছা নেই। সম্মেলনে এসে কোনো বিনিয়োগকারী সিদ্ধান্ত নেয় না, এ দেশে সে বিনিয়োগ করবে কী করবে না। আমাদের ইচ্ছা, অতীতের ইতিহাসের কারণে তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ বিষয়ে যে নেতিবাচক ধারণা আছে, তা ভেঙে দেওয়া। তাদের ধারণা দিতে চাই, বর্তমানের বাংলাদেশ নতুন এক বাংলাদেশ।’
বিনিয়োগকারীরা যা চান
এদিকে গতকাল নারায়ণগঞ্জে জাপানি বা বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বিএসইজেড) পরিদর্শনকালে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতি অপরিবর্তিত রাখা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার পাশাপাশি শুল্ক-কর ও গ্যাস-বিদ্যুতের মতো পরিষেবা নিশ্চিত করতে হবে। এতে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ পাবে। তাদের মতে, বিনিয়োগ করার পর নীতি পরিবর্তন করলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। অন্তর্বর্তী সরকার বিনিয়োগ-সংক্রান্ত যেসব নীতির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেগুলো পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের সময়েও অব্যাহত থাকবে কিনা, তা জানতে চান তারা।
পরিদর্শনকালে চীনা মালিকানার তথ্যপ্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান জিনিউ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী (সিইও) নিকোলাস কি বলেন, মূল সমস্যা হচ্ছে সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা না থাকা। বিনিয়োগ করার পার নীতি পরিবর্তন বিনিয়োগ সমস্যায় পড়ে।
সুইডিশ কোম্পানি নিলর্ন বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, বাংলাদেশে দুর্দান্ত সুযোগ দেখতে পাচ্ছি। তবে সরকার, বেজা এবং বিএসইজেড যেন তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। কারণ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হবে– সরকারের এমন প্রতিশ্রুতিতেই বিনিয়োগকারীরা আসছেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের সাক্ষাৎ
সফররত চীন ও কোরিয়ার পৃথক দুই বিনিয়োগকারী দল গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এর মধ্যে কোরিয়ার বিনিয়োগকারী দলে ৩০ জনের অধিক বিনিয়োগকারী ছিলেন। তারা চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেডের দীর্ঘদিনের সমস্যা দ্রুততম সময়ে সমাধানের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
এ ছাড়া মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে গতকাল বাংলাদেশের একটি যুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এর আগে ৫৩টি দেশের সঙ্গে এ চুক্তি হয়েছিল, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ৫৪তম দেশ। এ চুক্তির ফলে মহাকাশ গবেষণায় বাংলাদেশিরা সম্পৃক্ত হতে পারবেন।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আরও জানান, ব্রিকস দেশগুলোর গড়া নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে এ বৈঠক হয়েছে। ব্যাংকটি জানিয়েছে, তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এ বছর আরও ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।