বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

|

বৈশাখ ১ ১৪৩২

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

লালসালু মোড়ানো ‘হালখাতা’ ফাঁকা থাকার শঙ্কা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১২:৩৮, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

লালসালু মোড়ানো ‘হালখাতা’ ফাঁকা থাকার শঙ্কা

প্রতীকী ছবি

বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো ‘হালখাতা’। এদিন ব্যবসায়ীরা লাল মলাটের নতুন খাতায় লিপিবদ্ধ করেন নতুন বছরের হিসাব।

ছোট ব্যবসায়ীরা মহাজনদের পাওনা পরিশোধ করে থাকেন। বাঙালির চিরচেনা সেই হালখাতা উদযাপনের দৃশ্য আজ আর নেই বললেই চলে। এখন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা কেবলই ঐতিহ্য হিসেবেই পালন করে থাকেন হালখাতা। কারণ ব্যবসায়ীরা আগের মতো আর বকেয়া পরিশোধ না করায় কমেছে আয়োজনও। এ ছাড়া অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের জন্য এবছর গ্রাহকরা হালখাতা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন কম। ফলে হিসাবের খাতা ফাঁকা থাকার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

হালখাতা বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হলেও ইদানীং তাতে বাধ সেধেছে প্রযুক্তি। আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই সময়ে বিভিন্ন অ্যাপস ও অনলাইন শপিংয়ের কারণে হালখাতার সেই আগেকার দিনের জৌলুস কমে এসেছে। ব্যাংক, বিমা, কর্পোরেট অফিসগুলো বড় বড় বালাম খাতার পরিবর্তে কম্পিউটার নির্ভর হয়ে গেছে।

এতকিছুর পরও বাঙালি সংস্কৃতিতে নববর্ষের প্রথম দিনে হালখাতা চালুর প্রচলন একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। তবে রাজধানী ঢাকার তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার ও শাঁখারীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা এই ঐতিহ্য এখনো ধরে রাখতে স্বল্প পরিসরে ‘হালখাতা’ করে থাকেন। তারা উৎসবের আনন্দে হালখাতা উদযাপন করেন। বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন থেকে লালসালু মোড়ানো খাতায় হিসাব শুরু করেন ব্যবসায়ীরা।

রোববার (১৩ এপ্রিল) পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, শ্যামবাজার ও ইসলামপুরে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরেজমিন ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরজমিনে দেখা গেছে, দেশের অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ সার্বিক পরিস্থিতির জন্য এ বছর পহেলা বৈশাখ নিয়ে আলাদা কোনো আয়োজন করেননি পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। অথচ এ সময় ব্যবসায়ীরা দোকান-পাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, রং করাসহ বিভিন্ন সাজসজ্জা নিয়ে ব্যবস্ত থাকতেন। এবছর সেরকম কোনো কিছুই দেখা যায়নি। দুই-একটি দোকানে রঙিন হাঁড়ি, সোলার ফুল, রঙিন কুলা, ঘটের দেখা মিলেছে। ব্যবসায়ীদের মাঝে নেই উৎসবের আমেজ। টালি খাতা, পাটি ব্যবসায়ীদের হাকডাকও চোখে পড়েনি। হালখাতা উপলক্ষে ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণপত্র ছাপানো, মিষ্টির অর্ডারও করা কমে গেছে। মোট কথা হালখাতা নিয়ে উৎসবের আমেজ দেখা যায়নি। শুধু ঐতিহ্য রক্ষা করতে নামমাত্র হালখাতার অনুষ্ঠান করবেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে কোতোয়ালী রোডের বাংলাদেশ পোদ্দার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গগণ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর আমরা একদিন পর পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা অনুষ্ঠান উদযাপন করব। আমরা সনাতনী পঞ্জিকা অনুসারে অনুষ্ঠানটি করে থাকি। সে অনুসারে এবছর সরকারি হিসাবের একদিন পর আমাদের বছর শুরু হবে। তবে এবছর তেমন কোনো অনুষ্ঠার করা হচ্ছে না। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও মানুষের হাতে আর্থিক সংকট থাকায় ব্যবসাই ঠিকমতো পরিচালনা করা যাচ্ছে না। এরপর হালখাতা করলেও বকেয়া উঠে আসে না। এবছর কয়েক দিন আগে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান ঈদুল ফিতর গেল, মানুষের হাতে যা ছিল খরচ করে ফেলেছে, তাই এবছর অর্ধেক বকেয়াও উঠবে না। এজন্য ঐহিত্য রক্ষা করতে যেটুকু করা দরকার, সেটুকুই করা হবে।

কোতোয়ালি রোডের আরেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বিমল কর্মকার বাংলানিউজকে বলেন, এবছর পহেলা বৈশাখ বা হালখাতা উদযাপন নিয়ে তেমন কোনো আড়ম্বর নেই। কিছুদিন আগে ঈদ উদযাপন হলো। লোকজন পরিবারের চাহিদা মেটাতেই ব্যয় করে ফেলেছে। বকেয়া নিয়ে কম ভাববে, তাই আয়োজন নেই বললেই চলে। তবে ঐতিহ্য হিসেবে পহেলা বৈশাখের দিন দোকানে গণেশ পূজাসহ নতুন খাতা খোলা হবে। নতুন খাতা খোলা হলেও খাতা ফাঁকাই থেকে যাবে। এখন আর কেউ বকেয়া সহজে দিতে চায় না। এভাবে চললে একদিন পুঁজি হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাব।

তাঁতীবাজারের পোদ্দার ব্যবসায়ী শম্ভু নাথ বুলিয়ন স্টোরের স্বত্বাধিকারী শ্যামল সিং বাংলানিউজকে বলেন, বৈশাখ মানেই আনন্দ। আর পহেলা বৈশাখের জন্য আমরা সারা বছর আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করি। এদিন আমরা হালখাতা অনুষ্ঠান করে থাকি। তবে এবছর সরকারিভাবে সোমবার আর শুদ্ধ পঞ্জিকা অনুসারে আমরা মঙ্গলবার পহেলা বৈশাখ পালন করব। তাই আমরা মঙ্গলবার হালখাতা অনুষ্ঠান করব।

তিনি বলেন, এদিনই নতুন খাতায় নতুন বছরের হিসাব তুলে থাকি। হালখাতার দিন সকালে গণেশ পূজার মধ্য দিয়ে দিন শুরু হয় এবং সারাদিন গ্রাহদের মিষ্টিমুখ করিয়ে সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠান শেষ হয়। তবে বৈশাখ মাসব্যাপী আমাদের গ্রাহকরা আসেন তাদের পুরনো লেনদেনের হিসেব মেটাতে।

তাঁতীবাজারে স্বর্ণালংকার তৈরি করেন জনি ঘোষ। তিনি বলেন, এখন আর হালখাতা অনুষ্ঠান তেমন করে হয় না। আমরা শুধু ঐতিহ্য ধরে রাখতে বছরের প্রথম দিন দোকানে পূজা দিয়ে কিছু মিষ্টি বিতরণ করে থাকি। এখন আর কাস্টমারদের নিমন্ত্রণ দেওয়া হয় না। কারণ তাদের নিমন্ত্রণ দিলেও তারা আসে না। আয়োজন করলে ভেস্তে যায়। সেজন্য আর বড় করে আয়োজন করি না।

তিনি বলেন, কাস্টমার হচ্ছে আমাদের লক্ষ্মী। সারা বছর যারা বাকি স্বর্ণালঙ্কার কেনেন তারা পহেলা বৈশাখে প্রায় সব টাকা পরিশোধ করেন। কয়েক দিন আগে ঈদ গেল, এখন মানুষের কাছে টাকা নেই। এবছরও বকেয়ার খাতা ফাঁকা থেকে যাবে।

ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মো. শবজল বাংলানিউজকে বলেন, পহেলা বৈশাখে হালখাতা আমাদের প্রাণের অনুষ্ঠান। এদিনই আমরা ব্যবসায়ীরা নতুন খাতা খুলে থাকি। কারণ এদিন বছরের সব দেনা-পাওনার হিসাব নিষ্পত্তি করে পুরনো জঞ্জাল সরিয়ে নতুনভাবে বছর শুরু করি।

তিনি বলেন, হালখাতায় সাধারণত ছোট ব্যবসায়ীরা সারা বছর বাকিতে পণ্য নিলেও এদিনটিতে তা পরিশোধ করে থাকেন। এবছরও অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে অনেক ব্যবসায়ী বকেয়া পরিশোধ করবেন না। তাই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সামান্য আয়োজনে হালখাতা করা হবে।

শ্যামবাজারের হৃদয় টেডার্সের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম খান বলেন, বৈশাখে হালখাতা পুরান ঢাকার ঐতিহ্য। আগে একজন ক্রেতা লাখ লাখ টাকা বাকি পরিশোধ করতেন। তাদের খাওয়ানো, মূল্যবান উপহার দেওয়া হতো। কিন্তু এখন আর সেরকম কিছু করা হয় না। এবছর আমরা শুধু নামমাত্র হালখাতা অনুষ্ঠান করব। যাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করব তারা আগেই বলে দিয়েছেন, বকেয়া পরিশোধ করতে পারবেন না। তাই অযথা টাকা নষ্ট করে কোনো লাভ নেই।

শীতল পাটি বিক্রেতা জিয়াউল হক ৫৩ বছর ধরে তাঁতীবাজারে শীতল পাটি বিক্রি করেন। তিনি বলেন, এ বছর প্রায় ২০০ শীতল পাটি নিয়ে এসেছি। তবে বেচাবিক্রি নেই। পণ্যের দাম বেড়েছে। মানুষের ব্যবসা নেই, তাই কেউ এখন আর পাটি কেনেন না। বড় একটি পাটির দাম পড়বে ১৫০০ টাকা, মাঝারি ১২০০ টাকা, এর থেকে একটু ছোট পাটি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং একেবারে ছোট পাঠির দাম পড়বে ৩০০ টাকা।

টালিখাতা বিক্রি করেন সফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত ২৫ বছর ধরে এই এলাকায় টালিখাতা বিক্রি করি। দিন যত যাচ্ছে আমাদের বেচাবিক্রি তত কমে যাচ্ছে। আগে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার পিস খাতা বিক্রি করতাম। এখন আর সেটা করতে পারি না। কারণ ব্যবসায় প্রতিযোগিতা বাড়ছে কিন্তু গ্রাহক বাড়েনি বরং কমেছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে খাতার চাহিদা কমেছে। বর্তমানে একটা খাতা সর্বনিন্ম ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২০০ টাকায় বিক্রি করি। এ ছাড়া হালখাতার অনুষ্ঠান হলে এ খাতার চাহিদা থাকে বেশি। এখন আর আগের মতো হালখাতা অনুষ্ঠান হয় না, তাই চাহিদাও কমেছে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বৈশাখের বাজারে দেশীয় বাঁশ, বেত, কাঠের তৈরি জিনিস, মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, প্লাস্টিকের খেলনা, বিভিন্ন ধরনের মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু বাজারেই বিকিকিনি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর বাইরে আরও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয় বৈশাখী বাজারে। তাছাড়া ইলিশের বিকিকিনি হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। একইভাবে মিষ্টির দোকানগুলোয় বৈশাখে বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার মিষ্টি। সবমিলে বৈশাখকে ঘিরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন।

উল্লেখ্য, সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ বাংলা নববর্ষের প্রাণ। ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই ‘হালখাতা’র প্রচলন হয়। পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায়, তা-ই ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত। অতীতে জমিদারকে খাজনা দেওয়ার অনুষ্ঠান হিসেবে ‘পুণ্যাহ’ প্রচলিত ছিল। বছরের প্রথম দিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো।