রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

|

পৌষ ৭ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

সোনারগাঁয়ের প্রাচীন শহরে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ১৫ নভেম্বর ২০২১

সোনারগাঁয়ের প্রাচীন শহরে

সংগৃহীত

চুন সুড়কি দিয়ে তৈরি এক তলা থেকে তিন তলার ৫২টি বাড়ি নিয়ে বর্তমানের পানাম নগরী। সোনারগাঁর প্রাচীন শহর ছিলো পানাম। পানামের প্রাচীনত্ব বহন করে ট্রেজারার হাউস, সেতু, কোম্পানির কুঠি এবং প্রাচীন বনেদি ইমারতসমূহ।  

সোনারগাঁয়ের নান্দনিক চারু ও কারুশিল্পের জন্যে বিখ্যাত মসলিনের আড়ত ছিল পানাম নগর। ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনাগাঁওয়ে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো থান কাপড়, দেশ থেকে যেতো মসলিন।  

শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়তো পাল তোলা নৌকা। প্রায় সময়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠে পানাম নগরী।  

পরবর্তীতে এই পোশাক বাণিজ্যের স্থান দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য। ইংরেজরা এখানে বসিয়েছিলেন নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র। মূলত পানাম ছিলো বাংলার সে সময়কার ধনী ব্যবসায়ীদের বসতক্ষেত্র। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিলো ঢাকা-কলকাতা জুড়ে। তারাই গড়ে তোলেন এই নগর।

১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মোঘলদের সোনারগাঁ অধিকারের পর সড়ক ও সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানী শহরের সাথে পানাম এলাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। পানাম পুল, দুলালপুর পুল ও পানাম নগর সেতুর অবস্থান এবং তিনদিকের খাল-বেষ্টনি থেকে বোঝা যায় পানাম, সোনারগাঁর একটা উপশহর ছিলো।

হাজার বছরের প্রাচীন নগর সুবর্ণগ্রাম ছিল পূর্ব বাংলার অন্যতম রাজধানী ও নদীবন্দর। আজকের সোনারগাঁ প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। এই সুবর্ণগ্রামে তের শতকের স্থানীয় হিন্দু রাজা দনুজমাধব আসার পর থেকে ১৬১০ সালের পূর্ব পর্যন্ত সোনারগাঁ ছিল স্বাধীন সুলতানী বাংলার অন্যতম রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র।  

ঔপনিবেশিক সময়কালে এই এলাকায় বাণিজ্যিক, আবাসিক, ধর্মীয় স্থাপত্য কর্ম নির্মিত হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে পানাম নগরের অবস্থান। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে ধণাঢ্য হিন্দু বণিকদের দ্বারা পানাম নগরের গোড়াপত্তন ঘটে।  

পূর্ব দক্ষিণে বিস্তৃত প্রায় ৬০০ মিটার দীর্ঘ ও ৫ মিটার প্রশস্ত একটি সড়কের দুইপাশে সুরম্য  ৫২টি ভবন নিয়ে পানাম নগর। ভবনগুলোর অধিকাংশ আয়তকার এবং উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত। উচ্চতা একতলা থেকে তিনতলা।  

স্থাপত্যশৈলিতে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সাথে মুঘল শিল্পরীতির মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া নির্মাণশৈলীতে স্থানীয় কারিগরদের শিল্প কুশলতার প্রয়োগও ঘটেছে। বিভিন্ন পরিমাপের ইটের সঙ্গে চুন সুরকির আস্তর দিয়ে নির্মিত ভবনসমূহে ব্যবহৃত হয়েছে মোজাইক, রঙিণ কাঁচ, চিনিটিকরী, ছাদে কাঠের বীমবর্গা।  

চমৎকার স্টাকো অলংকরণে সমৃদ্ধ ভবনসমূহের দুইপাশে পরিবেষ্টিত পরিখা, ঘাটসহ পুকুর ও অনেকগুলো কূপ রয়েছে। ভবনগুলোর মধ্যে প্রাপ্ত লিপি অনুযায়ী, কাশীনাথ ভবন ১৩০৫ বঙ্গাব্দে নির্মিত, নীহারিকা ভবনের নাম পাওয়া যায়।  

পানাম নগরের পার্শ্ববর্তী গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে বড় সর্দার বাড়ি, পানাম সেতু, গোয়ালদী মসজিদ, মঠ, পোদ্দার বাড়ি টাকশাল, গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সমাধি উল্লেখযোগ্য। ভবনগুলোতে আগে কিছু লোক বসবাস করতো। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর এর দেখভালের দায়িত্ব নেওয়ার পর লোকজনকে সরিয়ে দেয়। আগে দর্শণার্থীরা ভিতরে ঢুকে ভবনগুলোর কারুকাজ দেখার সুযোগ ছিল।  

কিন্তু ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় ইটের দেওয়াল ও কাঠ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জীর্ণ ভেঙ্গে পড়া, খসে পড়া চুন সুড়কির জোড়া লাগানো ইটের ভবনগুলো দেখতে  প্রতিদিন শত শত লোক আসে পানাম নগরে, ইতিহাসের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টায় চলে অনুসন্ধান।