রোববার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

|

চৈত্র ২৮ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

সাহায্যের দোকান খুলেছিলেন আন্দোলনের নেত্রী

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১১:২৯, ১১ এপ্রিল ২০২৫

সাহায্যের দোকান খুলেছিলেন আন্দোলনের নেত্রী

ফাইল ছবি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ১৯শে জুলাই সানারপাড় এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হন বুলবুল শিকদার ও তার ছেলে রাকিবুল শিকদার। স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন বুলবুল ও তার ছেলে। বুলবুলের অবস্থার 
অবনতি হলে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) স্থানান্তর করা হয়। 

নারায়ণগঞ্জের ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া আফরিন আশরাফ  বুলবুলকে এক পর্যায়ে প্রস্তাব দেন আন্দোলনে আহতদের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হবে- বিনিময়ে আফরিনকে কিছু টাকা দিতে হবে। এ ছাড়াও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে চাকরি দিয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ৯০ হাজার টাকা নেন বুলবুলের কাছ থেকে। শুধু বুলবুল নন, আরও অনেকের কাছ থেকে এভাবে অর্থ নিয়েছেন আফরিন আশরাফ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আফরিনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ছাত্রআন্দোলনে অংশ নেয়ার সুবাদে আফরিন নারায়ণগঞ্জে আহত ও শহীদদের পরিবারকে সাহায্য করার নামে রীতিমতো দোকান খুলে বসেছিলেন। একে একে অভিযোগ আসায় তার বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশন। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাকে ডেকে এনে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আফরিনের এমন কর্মকাণ্ডের তথ্য পেয়ে ছাত্রআন্দোলন সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোও তাকে বহিষ্কার করেছে। 

জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল আমিন মানবজমিনকে জানান, আফরিন আশরাফ জাতীয় নাগরিক কমিটির সিদ্ধিরগঞ্জ শাখার সদস্য ছিলেন। জাতীয় নাগরিক পার্টিতে তিনি ছিলেন না। 

অভিযোগ থেকে জানা যায়, প্রতারণার লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জের জালকুঁড়িতে অফিস খুলেছিলেন আফরিন। এমনকি জেলা সিভিল সার্জন অফিসের আহত ও শহীদ পরিবারের তালিকাও সংগ্রহ করতেন। তালিকায় থাকা ফোন নাম্বারে যোগাযোগের জন্য একজন কলেজছাত্রকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তার অফিসে। এ পর্যায়ে আফরিনের প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে চাকরি থেকে সরে আসেন ওই শিক্ষার্থী। 

গতকাল আফরিনকে আটকের তথ্য পেয়ে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাইন্ডেশনের অফিসে ভিড় করেন প্রতারণার শিকার অনেকে।  সেখানে কথা হয় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বুলবুলের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ১৯শে জুলাই তার ছেলে রাকিবুলকে মোটরসাইকেলে করে আনতে যান বুলবুল শিকদার। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া হলে ছেলেকে নিয়ে মাঝখানে পড়ে যায়। দ্রুত মোটরসাইকেল চালিয়ে স্থান ত্যাগ করার সময় দুর্ঘটনায় পড়েন বুলবুল। সাইনবোর্ড এলাকায় প্রো-অ্যাক্টিভ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেন। অবস্থার অবনতি হলে বুলবুলকে ভর্তি করা হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)। কোনো একভাবে জুলাই আন্দোলনের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয় বুলবুল ও তার ছেলে রাকিবের। নারায়ণগঞ্জ ডিসি অফিস থেকে সেই তালিকা সংগ্রহ করে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে আফরিন ফোন করেন আহত বুলবুলকে। চিকিৎসার যাবতীর কাগজপত্র সত্যায়িত করার জন্য বুলবুলের কাছ থেকে নেয়া হয় ১০ হাজার টাকা।

আবার জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সহায়তার জন্য সরকারি তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির সময় নেই জানিয়ে আফরিন বলেন, যদি বুলবুল ও রাকিবুলের নাম এমআইএস-এ অন্তর্ভুক্তির জন্য ১ লাখ টাকা দেয়া হয় তাহলে কাজ করে দিবেন। বুলবুলের পরিবার থেকে প্রথমে চেকে ৫০ হাজার টাকা নেন তিনি। পরে বুলবুল ও রাকিবুলকে সরকারি সহায়তার জন্য করা তালিকা এ-ক্যাটাগরিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা এবং মাসিক ভাতা দেয়ার কথা বলে নেন আরও ৩০ হাজার টাকা। 

ওদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ২১শে জুলাই সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আহসান কবির শরীফ। শরীফের বাবা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে তার ছেলের সঙ্গে পুত্রবধূ হাফিজা আক্তার হ্যাপির ডিভোর্সের ভুয়া কাগজ জমা দেন। শহীদদের জন্য বরাদ্দ ৫ লাখ টাকা নেয়ার জন্য এ কাজ করেন তিনি। খবর পেয়ে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে অভিযোগ দিলে আটকে দেয়া হয় শহীদ শরীফের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা। এ তথ্য পেয়ে হ্যাপির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন আফরিন। টাকা পাইয়ে দেয়ার কথা বলে প্রথমে ২৫ হাজার টাকা নেন তিনি। পরে উভয় পরিবারের সমঝোতার ভিত্তিতে হ্যাপি জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলে সেখান থেকেও ২৫ হাজার টাকা নেন আফরিন। 

৫ই আগস্ট দুপুরে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে আহত হন মো. বেলাল হোসেন। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলায় হওয়ায় সেখান থেকে এমআইএস করান বেলাল। এ তথ্য জানতে পেরে বেলালকে নারায়ণগঞ্জ ডিসি অফিস থেকে আহতদের জন্য দেয়া ২০ হাজার টাকা পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ফোন দেন বেলালকে। পরে বেলালকে ডিসি অফিসে নিয়ে ২০ হাজার টাকার চেক দিয়ে সেখান থেকে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন আফরিন।  কৌশলে আফরিনকে টাকা না দিয়ে বাসায় চলে আসে বেলাল। পরে বেলালকে ফোন দিয়ে আফরিন জানান যদি ১০ হাজার টাকা দেন তাহলে পরবর্তীতে ডিসি অফিস থেকে আহতদের জন্য দেয়া ৫০ হাজার টাকাও পাবেন। বেলালের ব্যক্তিগত ঋণ থাকায় এক পর্যায়ে আফরিনকে ৮ হাজার টাকা দিতে রাজি হন। 

অঙ্কন দাস গত ১৭ই জুলাই রায়েরবাগে পুলিশের গুলিতে আহত হন। নারায়ণগঞ্জের খানপুরে চিকিৎসা নেয়া অঙ্কনকে ফোন করে ডিসি অফিস থেকে টাকা দেয়ার কথা বলে সব তথ্য চান আফরিন। পরে ডিসি অফিসে নিয়ে ২০ হাজার টাকার চেক দিয়ে জুলাই আন্দোলনে অন্য আহতদের সহায়তার জন্য ১০ হাজার টাকা দাবি করে আফরিন। অঙ্কন সেদিন টাকা না দিলেও পরবর্তীতে ডিসি অফিস থেকে আরও টাকা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ১০ হাজার টাকা নেয়া হয় অঙ্কন থেকে।

মানবজমিনকে অঙ্কন বলেন, আমি প্রায় ২ মাসের মতো বিছানায় পড়ে ছিলাম। আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। অনেক টাকা খরচ হয়েছে আমার চিকিৎসায়। কিন্তু আমাকে বিভিন্ন কথা বলে প্রতারণা করে যে ১০ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে আমি এই টাকা ফেরত চাই।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের লিগ্যাল অফিসার এডভোকেট পায়েল মানবজমিনকে বলেন, আমরা ইতিমধ্যে প্রতারণার বিভিন্ন ঘটনা শনাক্ত করছি। আমরা ভুয়া আহতদের চিহ্নিত করে মামলা দেয়া, মুচলেকা নেয়া এবং টাকা ফেরত চেয়ে শোকজ নোটিশ দেয়াসহ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। যেহেতু আফরিন আশরাফ জুলাই আন্দোলনের আহত এবং নিহত অনেক পরিবারের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, আমরা তাকে কোনোভাবেই ছাড় দিবো না। প্রতারণার অভিযোগে রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করে আফরিনকে পুলিশে দিয়ে দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। 

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান ভেরিফিকেশন কর্মকর্তা মো. হারুন মানবজমিনকে বলেন, আমরা এসব প্রতারকদের ব্যাপারে আগের চেয়ে অধিক সতর্ক। কোনো প্রতারকই ছাড় পাবে না। কে ছাত্র প্রতিনিধি, কিংবা নেতা-নেত্রী আমরা এসব আমলে নেই না। এ ফাউন্ডেশন শুধুমাত্র জুলাই আন্দোলনের আহত ও নিহতদের সহায়তা দেয়ার জন্য খোলা হয়েছে। 

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ মানবজমিনকে বলেন, এই ফাউন্ডেশনের টাকা বাংলাদেশের জনগণের টাকা। শহীদ ও আহতদের সহায়তার জন্য দেয়া এসব টাকা আমাদের কাছে আমানত হিসেবে দেয়া হয়। আমরা প্রকৃত আহত কিংবা শহীদ পরিবারকে দিয়ে থাকি। ফাউন্ডেশনের টাকা যেন কোনো ভুল মানুষের কাছে না যায় আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক আছি। ইতিমধ্যে প্রতারণার অভিযোগে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।