জ্যোতি বসুর পৈত্রিক ভিটা
পুরো নাম জ্যোতি বসু। সবাই ডাকতেন গণা বলে। প্রয়াত এ কমিউনিস্ট পার্টির বর্ষীয়ান নেতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের কলকাতার হ্যারিসন রোডের একটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান কলকাতাতে হলেও তাঁর পৈত্রিক ভিটা ছিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের বারদী ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া গ্রামে। সে সুবাদে তাঁর শৈশবের কিছুটা সময় কাটে এ গ্রামে। বর্তমান সরকার জ্যোতি বসুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণ করে একটি আধুনিক লাইব্রেরি, সেমিনার হল এবং জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে। এতে করে দিন দিন বাড়িটির প্রতি দর্শনার্থীদের আগ্রহ বেড়ে চলেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ২ একর ৪ শতক বাড়িটির মধ্যে রয়েছে প্রায় ১০০ বছরের পুরনো একটি দ্বিতল ভবন। রয়েছে একটি পুকুর এবং কুয়া। খাবার পানির জন্য জ্যোতি বসুর পরিবারের ব্যবহার করা এ কুয়াটি বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। দ্বিতল ভবনটির দেয়ালে সাঁটানো নামফলক থেকে জানা যায়, ১৩২৯ বাংলা সনের ১৩ অগ্রহায়ণ পাচু ওস্তাগারের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয় বাড়িটি। ভবনটির নিচতলায় রয়েছে দুটি শয়ন ঘর ও একটি বৈঠকখানা। দ্বিতীয়তলায়ও রয়েছে দুটি শয়ন ঘর। রয়েছে একটি বারান্দা।
মূলত বাড়িটির মালিক ছিলেন জ্যোতি বসুর নানা শরৎচন্দ্র দাস ও স্ত্রী খিরদা সুন্দরী। শরৎচন্দ্র দাস ও স্ত্রী খিরদা সুন্দরী দম্পতির একমাত্র মেয়ে হেমলতা বসুকে বিয়ে করায় বাড়ির মালিক হন স্থানীয় ডা. নিশিকান্ত বসু। জ্যোতি বসু ছিলেন ডা. নিশিকান্ত ও হেমলতা বসুর তৃতীয় সন্তান। ১৯৪০-১৯৪২ সাল পর্যন্ত জ্যোতি বসুর বাবা-মা এই বাড়িতে থাকতেন। এরপর তারা কলকাতা চলে যান।
জ্যোতি বসুর পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল এই গ্রামেই। বারদীতে তাদের যাতায়াত ছিল নিয়মিত। বিশেষ করে দূর্গাপুজার সময় তারা সবাই বারদীতে আসতেন। জ্যোতি বসুর বাবা ডা. নিশিকান্ত বসু ছিলেন একজন প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। পাশাপাশি ব্যবসাও ছিল তার। কলকাতা থেকে তিনি প্রায়ই এখানে বেড়াতে আসতেন। এ সময় তার সঙ্গে জ্যোতি বসুও আসতেন। জ্যোতি বসুর বাবা ডা. নিশিকান্ত বসু এলাকায় এন.কে. বসু নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছুটিতে এখানে বেড়াতে এলে বিনামুল্যে রোগীদের চিকিৎসা করতেন।
জ্যোতি বসু ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটানা ২৩ বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৮৭ সালে সপরিবারে তার স্মৃতিমাখা বারদী চৌধুরীপাড়ার পৈত্রিক বাড়িটি দেখতে আসেন। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে পৈত্রিক বাড়িতে আসেন তিনি। গাছের প্রতি তার বেশি ঝোঁক ছিল। তার হাতে রোপিত বিভিন্ন প্রজাতির গাছ তারই প্রমাণ। এতসব স্মৃতিমাখা পৈত্রিক বাড়ি জ্যোতি বসুকে সব সময় তাড়া করত।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় জ্যোতি বসু তাঁর এই পৈতৃক বাড়িটি পাঠাগারে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু এই মহান রাজনীতিবিদ ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করেন। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিদর্শন স্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১১ সালের ৪ আগষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ এখানে একটি পাঠাগার, সেমিনার হল ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। ২০১৩ সালের ১৪ আগষ্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জ্যোতি বসু স্মৃতি ও জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তবে পাঠাগারে জ্যোতি বসুকে নিয়ে লেখা কোনো বই স্থান না পাওয়া অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া পাঠাগারের মিউজিয়াম কক্ষটি এখনো খালি পড়ে রয়েছে।
ছোটবেলায় জ্যোতি বসুর মা হেমলতা বসু মারা গেলে শহীদুল্লার মা আয়াতুন নেছা তাকে দেখভাল করতেন। পরে তার ছেলে শহীদুল্লাহকে এই বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে ওই বাড়িতে শহীদুল্লাহ তার পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।
বারদী বাজার এলাকার কবির হোসেন মৃধা নামে এক কলেজ শিক্ষক জানান, পশ্চিমবঙ্গের কিংবদন্তী এ নেতা আমাদের বারদী ইউনিয়নের সন্তান। জ্যোতি বসু আমাদের সোনারগাঁয়ের গর্ব। পূর্বে এই বাড়িটি অবহেলায় পড়ে থাকলেও সরকার এখন এটির দিকে নজর দিয়েছে। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য যেনো আরো প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করে।
দায়িত্বরত পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান মাজেদা আক্তার বলেন, জ্যোতি বসুর বাড়িটি ঘিরে দর্শনার্থীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। পাঠাগারে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের এক হাজার ২০০ বই। এছাড়া দুই হাজার টাকার বিনিময়ে হলটি ভাড়া নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানান তিনি। রোববার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বাড়িটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।
জ্যোতি বসুকে নিয়ে লিখা কোনো বই না থাকা এবং মিউজিয়াম কক্ষটি খালি থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা তাকে নিয়ে লিখা বই সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি এবং মিউজিয়ামের বিষয়ে আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবো। জ্যােতি বসুর বাড়ি নিয়ে বর্তমান সরকারের কিছু কার্যক্রম চলমান রয়েছে সেগুলোর কাজ শেষ হলে এ বাড়িটি দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হবে।