
মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়ক
সংস্কারের ছয় মাস না যেতেই নারায়ণগঞ্জের মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়কের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে বড় বড় গর্ত। পিচ উঠে গিয়ে যান চলাচলে মারাত্মক দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে। প্রায়ই যানবাহন উল্টে হতাহতেরও ঘটনা ঘটছে।
২০২৩ সালের শেষদিকে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের সংস্কার কাজ শেষ হয়। শিল্পাঞ্চল ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করায় এ সড়কটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যতম ব্যস্ততম সংযোগ সড়ক। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সড়কটি এখন ‘মরণ ফাঁদে’ পরিণত হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এর মতে, অতিরিক্ত ওজনের পণ্যবোঝাই ট্রাক ও লরি বিশেষ করে সিমেন্ট কারখানার যান চলাচলই সড়কের ক্ষতির প্রধান কারণ। আর স্থানীয়রা বলছেন, ‘নিম্নমানের’ সামগ্রী ব্যবহার ও ‘অনিয়ম’ সড়কের বেহাল দশার কারণ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সওজের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহিম বলেন, “সড়কটির বেহাল দশা নিয়ে আমরাও চিন্তিত। ওভারলোডেড গাড়ি এই সড়কে চলাচলের কথা ছিল না। কিন্তু ওভারলোডেড যান চলাচল থামানোও যাচ্ছে না।”
তবে পরিবহন মালিক ও সিমেন্ট কোম্পানির কর্মকর্তারাও ভারী যান চলাচলের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। কিন্তু বিকল্প না থাকায় ‘নিরুপায়’ হয়ে সড়কটি ব্যবহার করছেন বলে তারা জানিয়েছেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন দশক আগে বন্দর উপজেলার বাসিন্দাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য পুরাতন রেল লাইনের ওপর ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কটি নির্মাণ করা হয়। প্রথমে এ সড়ক দিয়ে ছোট যানবাহন চলাচল করত।
পরে ২০২২ সালের অক্টোবরে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলে সড়কটির গুরুত্ব বেড়ে যায়। এই সড়ক ব্যবহার করলে, পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতে প্রায় ৯ কিলোমিটার পথ কমে যায়। ফলে সড়কটি প্রশস্ত ও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সড়কটি মেরামতের পর ৬ মাসের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ফাটল ও গর্ত দেখা দেয়। পিচ উঠে যেতে শুরু করে।
বন্দর থানা পুলিশ বলছে, গত ছয় মাসে মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়কে অন্তত পাঁচটি বড় দুর্ঘটনার তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। তবে, এই সংখ্যা ‘কয়েকগুণ’ বলে দাবি স্থানীয়দের।
সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে স্থানীয়রা জীবন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে বলে বন্দর রেললাইন এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ বাতেন জানান।
আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, “সড়কের কাজটা ভালো হয় নাই। মেরামতের পর ছয় মাসও টেকেনি সড়কটি। অনেক জায়গায় দেবে গেছে; আর গর্তের তো অভাব নাই। এ ছাড়া প্রায় সময় গাড়ি উল্টে যায়।”
“সম্প্রতি এ সড়কের গর্তে পড়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার বাগবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. শাওন বলছিলেন, “গাড়ি উল্টে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যাওয়া এই সড়কের নিত্যদিনের ঘটনা। সন্ধ্যার পর এ সড়ক মরণ ফাঁদে পরিণত হয়।”
স্থানীয়দের অভিযোগের প্রমাণ মিলল সরেজমিনে। সড়কটির বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্ত দেখা গেছে। গর্তে চাকা আটকে যাচ্ছে প্রায়ই। অনেক জায়গায় বড় অংশজুড়ে সড়কের পিচ উঠে গেছে। এবড়ো-থেবড়ো এ পথ পাড়ি দিতে রীতিমত যুধ করতে হয় চালক ও যাত্রীদের। কিন্তু বিকল্প না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে এ সড়কেই নিয়মিত যাতায়াত করছে হচ্ছে স্থানীয়দের।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে শাহ সিমেন্টের একটি ট্রাক উল্টে সড়কের পাশে পড়ে গেলে চালক ও হেলপার গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার পরদিন আরেকটি ট্রাক একইভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা।
কী বলছে সওজ ও পুলিশ
সওজের কর্মকর্তারা জানান, তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু এ সড়কের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিলে সড়কটি প্রশস্ত ও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১১ কিলোমিটারের সড়কে পিচ ঢালাই (মূলত ওভারলেপ), চারটি কালভার্ট ও একটি সেতু নির্মাণে সাড়ে ৫৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ২০২৩ সালের শেষদিকে সড়ক মেরামতের কাজ শেষ হয়।
অতিরিক্ত ওজনের পণ্যবোঝাই ট্রাক ও লরির কারণে মেরামতের পর ছয় মাসের মধ্যে সড়কটি দ্রুত নষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে আশেপাশের সিমেন্ট কারখানার ভারী যানবাহনগুলো মোক্তারপুর-পঞ্চবটি সড়কের নির্মাণকাজ চলার কারণে বিকল্প হিসেবে মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়ক ব্যবহার করছে। এসব ভারী যানবাহন কোনও ধরনের ওজন নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলাচল করে; যা নতুন সড়কের স্থায়িত্ব কমিয়ে দিয়েছে।
সওজ কর্মকর্তারা জানান, এ সড়কে ভারী যান চলাচল বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ অফিস। গত ৭ থেকে ৯ ডিসেম্বর পুলিশের সহযোগিতায় দুই শতাধিক ভারী যানের কাগজপত্র যাচাই করে সওজ। এতে ওজনসীমার চেয়েও ১০ থেকে ২০ টন অতিরিক্ত পণ্য বহনের সত্যতাও পাওয়া যায়। পরে ওজনসীমার অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই গাড়িগুলো উল্টো পথে ঘুরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
বর্তমানে সড়কটি যান চলাচলের জন্য একেবারেই অনুপযোগী বলে বন্দর থানার ওসি তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “গত ছয় মাসে এই সড়কে পাঁচটা মেজর দুর্ঘটনা ঘটেছে। সড়কের অবস্থা আসলেই খুব খারপ। এ সড়কে ভারী যান চলাচল বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ অফিস। তাদের অভিযানে আমরা সহযোগিতাও করেছিলাম।”
ওভারলোডেড ট্রাক
মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়কের নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করেন অটোরিকশা চালক বাচ্চু মিয়া।
তিনি বলছিলেন, দিন-রাত প্রচুর ভারী লরি ও ট্রাক চলে এই সড়কে। যারা নিয়মের তোয়াক্কা না করেই দ্রুতগতিতে পণ্য পরিবহন করে। এত ওজন সহ্য করতে না পেরে রাস্তা দেবে গেছে।
ভারী যানচলাচলের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীরের দুপাড়ে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ অংশে গড়ে উঠেছে শাহ, প্রিমিয়ার, ক্রাউন, মেট্রোসেম, আকিজ, সেভেন রিংসসহ দেশের বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদনকারী কারখানা। এসব কোম্পানির ভারী যান সাধারণত মোক্তারপুর-পঞ্চবটি সড়কে চলাচল করলেও ওই আঞ্চলিক সড়কটিতে নির্মাণকাজ চলায় বর্তমানে যানবাহন মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়ক হয়ে চলাচল করছে।
সম্প্রতি ১৫ মিনিটের পর্যবেক্ষণে মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়কে ২১টি পণ্যবোঝাই ট্রাক চলাচল করতে দেখা গেছে। যার অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন কোম্পানির সিমেন্টবাহী ট্রাক। রাতে যান চলাচল আরও বেড়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে সওজের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের এক প্রকৌশলী বলছিলেন, “এটি আঞ্চলিক মহাসড়ক হলেও ওভারলোডেড যান চলাচলের উপযোগী নয়। সিমেন্ট কোম্পানিগুলো ও পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের যানবাহনে অতিরিক্ত পণ্য বহনে নিরুৎসাহিত করতে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সাড়া দেননি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও জানেন।”
বর্ষা মৌসুম আসার আগেই সড়কটি মেরামতের প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, “শুধু ওভারলেপ দিয়ে হবে না। বড় বরাদ্দ না আসলে মেরামতের পরও অল্প সময়ের মধ্যে পুরোনো অবস্থায় ফিরে আসবে।”
ভারী যান চলাচল বন্ধে সওজের চিঠি পেয়েছিলেন কী-না জানতে চাইলে চরসৈয়দপুর ট্রান্সপোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি আসলাম সরকার বলেন, “আমরা তো গাড়ি ভাড়া দেই। অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই তো করে যারা ভাড়া নেন তারা। এতে আমাদের কোনো হাত নেই।
“সারাদেশের সব সড়কেই তো অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যান চলছে। সরকার যদি কড়া নিয়ম করে তাহলে এর পরিবর্তন হবে, নইলে না।”
মোবাইলে ফোনে যোগাযোগ করা হলে ওজনসীমার অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন শাহ সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (রোড ট্রান্সপোর্ট অপারেশন) মনির উদ্দিন আহমেদ।
পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতি পোষাতে প্রতি যাত্রায় অতিরিক্ত পণ্য বহন করতে বাধ্য হন তারা। শুধু সিমেন্ট কোম্পানি নয়, এ চর্চা সকল পণ্যবাহী যানে চলে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়কটির অবস্থা খুবই খারাপ, এর জন্য ভারী যানবাহনগুলোও কিছুটা দায়ী। কেননা, এত লোডের জন্য রাস্তাটা তৈরি হয়নি। কিন্তু আমরা তো নিরুপায় হয়ে এ পথ ব্যবহার করছি। পঞ্চবটি-মোক্তারপুর সড়কটির কাজ শেষ হলে, এ সড়কে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি কেন, কোন ভারী যানই ঢুকবে না।”
এ সড়ক মেরামতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে সিমেন্ট কোম্পানিগুলোও সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত বলে জানান মনির উদ্দিন।
সড়কটির বেহাল দশা থেকে কবে পরিত্রাণ মিলবে জানতে চাইলে সওজের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহিম বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সংস্কারের চিন্তাও আমরা করছি। কিন্তু সড়কটির দুই পাশে নিচু জমি থাকায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন।”
তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণের পর এ সড়কে যানবাহন বেড়ে গেলে বিগত সরকারের আমলে সড়কটিকে ছয় লেনে রূপান্তরের পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছিল। তবে, ওই প্রকল্পের বিষয়ে নতুন কোনও অগ্রগতি নেই।”
সূত্র: বিডি নিউজ