
ফাইল ছবি
ষাটোর্ধ্ব দুস্থ নারীর বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর তিনি স্থানীয় কয়েকজন নারীর সঙ্গে ঢাকায় আসেন। তাঁরা কমলাপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আর্থিক সাহায্য পেতে মানুষের কাছে হাত পাতেন। কয়েক দিন পর ওই নারীর সঙ্গে আসা অন্যরা নারায়ণগঞ্জে ফিরে যান। তিনি একা থেকে যান আরও সাহায্য পাওয়ার আশায়। ৬ সেপ্টেম্বর ঘোরাঘুরি শেষে দিবাগত রাত ১টার দিকে রমনা কালী মন্দিরের সামনে যান তিনি।
সেখানে সাত-আটজন তাঁকে আর্থিক সাহায্য করার প্রলোভন দেখিয়ে পাশে গ্লাস টাওয়ারের কাছে নিয়ে যান। সেখানে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ওই নারী। একপর্যায়ে জ্ঞান হারান তিনি। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ খবর পেয়ে শাহবাগ থানা-পুলিশ অচেতন অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। তবে সাড়ে সাত মাস পরও পুলিশ কোনো আসামিকে শনাক্ত করতে পারেনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক চেষ্টা করেও ওই নারীকে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ১ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা মহানগরে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৭টি। ধর্ষণের অভিযোগে হয়েছে ২১৬টি মামলা। আর ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে ২৭টি। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার নারীদের বেশির ভাগই তরুণী ও গৃহবধূ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন তরুণী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। ভুক্তভোগীদের একজন পোশাকশ্রমিক। আরও কয়েকজন শিশু ও তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়ে ওসিসিতে চিকিৎসা নিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থার কারণে ঢাকা মহানগরে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আরফান উদ্দিন খান। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
সব আসামি গ্রেপ্তার হয়নি
দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ করা একটি মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, ভুক্তভোগী তরুণীর বয়স ২১ বছর। তিনি স্বামীর সঙ্গে পুরান ঢাকায় থাকেন। তাঁর স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তাঁর চাকরি চলে যায়। এ পরিস্থিতিতে সংসারের হাল ধরতে তরুণী নিজে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা চালান। এই সূত্রে রিয়াদ নামের এক তরুণের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। চাকরির বিষয়ে কথা বলার জন্য গত বছরের ২৯ নভেম্বর তুরাগ এলাকায় ওই তরুণীকে ডেকে নেন রিয়াদ। পরে সন্ধ্যায় একটি লেকের পাশে নিয়ে তাঁকে তিনজন মিলে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনার কয়েক দিন পর ভুক্তভোগী তরুণীর মা তিনজনের নাম উল্লেখ করে তুরাগ থানায় মামলা করেন। তবে পুলিশ এ পর্যন্ত মাত্র এক আসামিকে ধরতে পেরেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের পরিদর্শক আমেনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার সাব্বিরসহ অন্য দুজন তরুণীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেছেন। এক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি রাজধানীর দক্ষিণখানে মা-বাবার সঙ্গে থাকত। গত ১৬ জানুয়ারি মা-বাবাকে কেনাকাটার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়। এরপর আর বাসায় ফেরেনি। ১৯ জানুয়ারি দক্ষিণখান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন কিশোরীর বাবা। পরে ২ ফেব্রুয়ারি হাতিরঝিল থেকে কিশোরীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার দুই যুবক পুলিশকে জানিয়েছেন, হাত-পা বেঁধে পাঁচজন মিলে ধর্ষণের পর কিশোরীকে হত্যা করেন তাঁরা।
এ ঘটনায় জড়িত বাকি তিনজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের সহকারী কমিশনার (দক্ষিণখান জোন) মো. নাসিম এ-গুলশান।
১৪ বছরের কিশোরী মা-বাবার সঙ্গে রাজধানীর কদমতলী এলাকায় থাকে। গত ২০ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে সে খালার বাসায় যাচ্ছিল। পথে পাঁচ যুবক তাঁকে ঘিরে ধরে। পরে পাশের একটি পরিত্যক্ত টিনের কক্ষে নিয়ে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় কিশোরীর বাবা থানায় মামলা করেন। এখন পর্যন্ত পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে।
ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তালেবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের নজরে আসার পর এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। তবে দু-একটা ঘটনায় হয়তো জড়িত প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
‘উদ্বেগজনক খবর’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত রাজধানীর তুরাগ, কদমতলী, যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা থানায় ২টি করে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। আর কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, বনানী, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, ভাষানটেক, কাফরুল, শাহ আলী ও দারুসসালাম থানায় হয়েছে ১টি করে।
ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর খুনের ঘটনায় জড়িত সব আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সালমা আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাড়ে সাত মাসে কেবল ঢাকা মহানগরে এতগুলো ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সেটি ভীষণ উদ্বেগজনক খবর। আবার ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত প্রত্যেককে যদি পুলিশ ধরতে না পারে, বিচারের আওতার বাইরে থেকে যায়, তখন ভুক্তভোগীর মনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম হয়। সালমা আলী বলেন, ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।