ফাইল ছবি
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার কারখানায় আগুনে বিধ্বস্ত ছয়তলা ভবনের ভেতরে ঢুকে মানুষের মাথার খুলি ও পোড়া হাড়গোড় পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা। পরে ভবনটিতে পাওয়া দেহাবশেষ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন তারা।
জানা গেছে, জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যটা রোববার (১ নভেম্বর) উপজেলার রূপসী এলাকায় অবস্থিত গাজী টায়ার কারখানার ভেতরে গণ শুনানি কার্যক্রম শেষ করে চলে গেলে নিখোঁজদের স্বজনরা এক প্রকার জোর করেই ভেতরে প্রবেশ করেন। বিক্ষুব্ধ স্বজনরা তখন ভবনটির নিচ তলার ভেতরে ঢুকে গণহারে তল্লাশি শুরু করেন। এসময় এলাকাবাসীও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। তাদের অনেকে ভবনটির তৃতীয় তলা পর্যন্ত উঠে যান। সেখানে তারা মেঝেতে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় মানুষের মাথার খুলিসহ বেশ কিছু পোড়া হাড়গোড় পেলে তদন্ত কমিটি, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।
গত ২৫ আগস্ট দিনভর লুটপাটের পর রাতে কারখানাটিতে আগুন দেয়ার ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন উপজেলার মৈকুলী গ্রামের বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি শাহাদাত হোসেন। ভাইয়ের খোঁজে অন্যদের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির তৃতীয় তলা পর্যন্ত উঠে যান সিনথিয়া। সেখানে একটি মাথার খুলি পান তিনি। যার অধিকাংশই পুড়ে গেছে।
সিনথিয়া বলেন, 'সবার সঙ্গে আমিও ফ্যাক্টরিতে ঢুইকা যাই। তিনতলায় অনেক হাড়গোড় দেখছি। অনেকেই হাতে নিয়া গেছে। আমিও একটা খুলি নিয়া আসছি।'
নিখোঁজ ব্যাটারি কারখানার শ্রমিক আমান উল্লাহর বৃদ্ধা মা রাশিদা বেগম বলেন, 'দিনের পর দিন যাইতাছে অথচ কেউ কইতাছে না আমার পোলা কই আছে। এতো লোক আইতাছে কেউ মরদেহের কোন খোঁজ জানাইতে পারতাছে না। আগুনে পুইড়া গেলে হাড্ডিগুড্ডি অইলেও দিতে অইব। মরদেহ না পাইলে আমরা কারখানার সামনে থেইকা যামু না।'
পরে খুঁজে পাওয়া খুলি ও পোড়া হাড়গোড়গুলো স্বজনরা কারখানায় উপস্থিত পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
এর আগে রোববার (১ নভেম্বর) বেলা এগারোটা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কারখানাটির ভেতরে প্রধান ফটকের সামনে প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনদের নিয়ে গণ শুনানি কার্যক্রম। পরিচালন করে তদন্ত কমিটি। এসময় স্বজনদের কাছ থেকে নিখোঁজদের ছবি সংগ্রহ ও নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধসহ তাদের সর্বশেষ অবস্থান জানতে মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে নানাভাবে পর্যবেক্ষণ করে তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
গণ শুনানি শেষে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা মাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, স্বজনদের দেয়া তথ্যমতে নিখোঁজ ৮০ জনের তালিকা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, নিখোঁজদের স্বজন ও কারখানার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকে আদ্যোপান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছি। আমরা স্বজনদের দেয়া নাম ঠিকানা অনুযায়ী নিখোঁজ ৮০ জনের তালিকা তৈরি করেছি। এছাড়া এ ঘটনায় ইতোপূর্বে স্থানীয় শিক্ষার্থী ও উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার তৈরি করা তালিকাগুলো যাচাই বাছাই করে নিখোঁজদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করব। এরপর ১০ কার্য দিবসের মধ্যে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করব।'
এদিকে গণ শুনানি চলাকালে দুপুর একটার দিকে নিখোঁজদের সন্ধানের দাবিতে কারখানার সামনে প্রায় ১৫ মিনিট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন এলাকাবাসী ও স্বজনরা। এসময় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা বুঝিয়ে অবরোধকারীদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে আনেন। পরে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
দুপুর আড়াইটায় তদন্ত কমিটির সদস্যরা, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের টিম কারখানা থেকে বের হলে বাইরে অপেক্ষমান ক্ষুব্ধ স্বজনরা ও এলাকাবাসী ভেতরে ঢুকে পড়েন। এরপরই তারা ঝুঁকিপূর্ণ পোড়া ভবনটির ভেতরে প্রবেশ করে তল্লাশি চালিয়ে মানুষের খুলি ও হাড়গোড়গুলো পায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান বলেন, ‘গণ শুনানি কার্যক্রম শেষে আমরা যখন উপজেলা পরিষদে গিয়ে অবস্থান করি তখন জানতে পারি নিখোঁজদের স্বজনরা ভবনটির ভেতরে ঢুকে পড়ে সেখানে মানুষের কিছু হাড়গোড় পেয়েছে। পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) কে বিষয়টি জানালে তিনি এসব দেহাবশেষ সংগ্রহ করার জন্য আমাদের নির্দেশনা দেন। পরে আমরা পুলিশকে নির্দেশ দিলে তারা,সে অনুযায়ী কাজ করে। তাদের অনুরোধে স্বজনরা খুঁজে পাওয়া দেহাবশেষগুলো পুলিশের কাছে জমা দেন। প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে এসব দেহাবশেষ শনাক্তের প্রক্রিয়াকরণ করা হবে।’
গত ২৫ আগস্ট আগুনের ঘটনার পাঁচদিন পর গত ৩০ আগস্ট (শুক্রবার) সন্ধ্যায় ছয়তলা ভবনটির আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ (নেভানো) হলে অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রম শেষ করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। তবে রোববার গণ শুনানি চলাকালে ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম সেখানে অবস্থান করেন।
হাড়গোড় পাওয়ার বিষয়ে সংস্থাটির নারায়ণগঞ্জ জোন-২ এর উপসহকারী পরিচালক ও তদন্ত কমিটির সদস্য আব্দুল মান্নান জানান, ‘বুয়েটের অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীগণ গত বৃহস্পতিবার পরিদর্শন করে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করায় উদ্ধার অভিযান চালানো যায়নি। তবে তাদের পরামর্শে ওইদিন ভবনের নিচতলার বেজমেন্টে ঢুকে আমরা তল্লাশি করেছিলাম। ড্রোন, ল্যাডার মেশিন ও টিটিএলের (উঁচু মই) মাধ্যমে ভবনটির ভেতরেও অনুসন্ধান করেছি। তবে কোন মানুষের মরদেহ বা তাদের দেহাবশেষ পাওয়া যায় নি।’