হেনা বেগম
বাড়ি এসে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা ছিল মো. মামুন মাদবরের। আগের রাতে লোডশেডিং হলে মেস থেকে নিচে নেমেছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। ঢাকার রামপুরায় সেই রাতেই (১৮ জুলাই) গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন মারা যান তিতুমীর কলেজের স্নাতকোত্তরের এই শিক্ষার্থী। শরীয়তপুরের বাড়িতে ১০ দিন পরও সেই শোক কাটেনি।
মাদ্রাসাছাত্র মো. ইমরান মিয়া (১৭) ছুটিতে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মা-বাবার কাছে গিয়েছিল। ২২ জুলাই ঝামেলার কারণে বাইরে যেতে মানা করেছিলেন মা। একটি মোজো কেনার জন্য তিন মিনিট সময় চেয়ে বের হয় ইমরান। পরে ফেরে তার গুলিবিদ্ধ লাশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের বাড়িতে দাফন হয়েছে তার। লাশ কবরে নামানোর পর থেকে গলা দিয়ে কিছু নামছে না শোকাহত বাবার।
পরিবারের অবস্থা বদলের স্বপ্ন থামল মামুন মাদবর (২৫) শরীয়তপুর সদরের শৌলপারা ইউনিয়নের চর চিকন্দি গ্রামের আব্দুল গনি মাদবর ও হেনা বেগম দম্পতির ছোট ছেলে। তাঁর বড় এক ভাই সৌদি আরব থাকেন। অন্য দুই ভাই ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করেন। অর্থনৈতিক কারণে বড় তিন ভাই পড়াশোনা করতে পারেননি তেমন। শৈশব থেকেই মেধাবী মামুনকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল পরিবারের অবস্থা বদলের স্বপ্ন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়ার পাশাপাশি কাজ করতেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। সেই আয় থেকে বাড়িতে একটি আধাপাকা ঘরও নির্মাণ করেন। দুই কক্ষের সেই বাড়িতেই থাকেন মা হেনা ও বাবা গনি মাদবর।
স্বজনরা জানান, চাকরি নিয়ে আগামী ২২ আগস্ট মধ্য আমেরিকার দেশ বেলিজ যাওয়ার কথা ছিল মামুনের। কিন্তু গুলি থামিয়ে দিয়েছে সেই স্বপ্নযাত্রা। রোববার বারান্দার খুঁটি ধরে আহাজারি করছিলেন হেনা বেগম। তিনি বলেন, ১৮ জুলাই সন্ধ্যার দিকে মামুন ওর অসুস্থ বাবার খোঁজখবর নিতে ফোন করেছিল। অবস্থা ভালো না দেখে ফোনেই শরীয়তপুরের একটি হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর সিরিয়াল রাখে। মাকে সে জানায়, পরদিন বাড়িতে এসে সন্ধ্যা ৭টায় বাবাকে ডাক্তার দেখাবে। হেনা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার বাবা আর আসলো না, আসলো ওর লাশ। কীভাবে যে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝলাম না।’
স্থানীয় শৌলপারা মনর খাঁ উচ্চ বিদ্যালয় ২০১৬ সালে এসএসসি পাস করেন মামুন। ২০১৮ সালে শরীয়তপুর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকার তিতুমীর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ভর্তি হন। একই কলেজে ২০২৩-২৪ সেশনে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। বন্ধুদের সঙ্গে রামপুরার ওয়াপদা রোডের মেসে থাকতেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী পারভেজও থাকেন মামুনের মেসে। তিনি বলেন, ১৮ জুলাই রাত ১১টার দিকে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তারা পাঁচজন এ জন্য বাসা থেকে নেমে গলিতে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। মামুন একটু সামনে হেঁটে গলির মাথায় চলে যান। কিছুক্ষণ পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি গাড়ি থেকে গুলি চালানো হয়। পালানোর সময় একটি বুলেট মামুনের মাথায় ঢুকে বের হয়ে যায়। উদ্ধার করে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরদিন বেলা ১১টার দিকে তিনি মারা যান।
বড় ভাই রুবেল বলেন, ‘মামুন অনেক মেধাবী ছিল। ও নিজের প্রচেষ্টায় এতদূর এসেছে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে রোজগার করত। ওর আয়ের ওপর পরিবার নির্ভরশীল ছিল। এখন আমাদের পরিবার কীভাবে চলবে জানি না।’
তিন মিনিটের জন্য গিয়ে চিরবিদায়
“আমার পুলা হের মায়ের কুলে ঘুমাই আছিন। ইকটু পরে কয়, ‘আম্মা আমার খুব তাইস (তৃষ্ণা) করতাছে। তিন মিনিট সময় দিবানি, একটু দোকানে যামু। একটা মজু খাইয়া আবার আইসা পড়ুম।” কথাগুলো বলছিলেন ইমরানের বাবা মো. ছোয়াব মিয়া। ছেলের এই যাওয়াই যে শেষ যাওয়া হবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।
ইমরান গুলিবিদ্ধ হয় ২২ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাহেবপাড়া এলাকায়। বাড়ি বাড়ি ফেরি করে পুরোনো কাপড় বিক্রি করেন ছোয়াব মিয়া। এখানেই সংসার নিয়ে থাকেন। তাঁর বাড়ি নাসিরনগরের গোয়ালনগর ইউনিয়নের রামপুর গ্রামে। ইমরান পড়ত হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার জিরুন্ডা মানপুর তোফালিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর ঢাকার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয় সে। হঠাৎ মাদ্রাসা বন্ধ হওয়ায় মা-বাবার কাছে নারায়ণগঞ্জের সাহেবপাড়ায় যায় ইমরান।
রোবরার রামপুর গ্রামে দেখা যায়, ইমরানের পরিবারের দোচালা টিনের ভাঙা ঘর। এতে দুটি কক্ষ। একটিতে দাদা-দাদি থাকেন। বাড়ি এলে অন্য কক্ষে উঠতেন ইমরানের পরিবারের সদস্যরা। বাড়ির উঠানে বসে বিলাপ করছেন দাদি নিহারা বেগম। তিনি বলেন, “কিতা আর কমু! বুকের ধন কাইরা নিছে। নারায়ণগঞ্জ যাওনের আগের দিন আমার গলায় ধইরা একটা চুমা দিয়ে কইছিন, ‘দাদি আমি আবার কিছুদিন পর বাড়িত আইয়া পরুম। তুমি চিন্তা কইর না।’ আমার নাতি বাড়িত আইছে ঠিকই, কিন্তু লাশ হইয়া আইছে। এই বিচার আল্লাহ করব।”
স্বজনরা জানান, ২২ জুলাই সকালে ঘুমিয়ে ছিল ইমরান। হঠাৎ মায়ের কাছে তিন মিনিটের জন্য বাইরে যাওয়ার আবদার করে। সে বলেছিল, একটি মোজো খেয়েই ফিরে আসবে। মোজো কিনে মুখে দিতেই পেছন থেকে গুলি লাগে তার বুকে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ইমরান। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ গ্রামের বাড়িতে আসে পরদিন বিকেলে। স্থানীয় সামাজিক কবরস্থানে দাফন হয়েছে তার। কোরআনে হাফেজ ছেলে হত্যার বিচার আল্লাহর কাছেই রাখেন ছোয়াব মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমার বুকের ধন মরণের আগে খাইতে পারে নাই। আমি আর খাইয়া কিতা করুম। পুতের লাশ কবরে দেওনের পর থেইক্যা গলা দিয়া কিছু যায় না। হের লাইগ্যা সাত দিন ধইরা কিছুই খাই না।’