ফাইল ছবি
নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামল জুড়েই জেলায় কোনঠাসা ছিল নারায়ণগঞ্জ বিএনপি। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর কাছে জিম্মি ছিল পুরো জেলা। নিজ দলের বাইরেও বিএনপিসহ অন্যান্য দলের রাজনীতিও প্রভাবিত করতেন শামীম ওসমান। অনেকের প্রশংসাও করতে দেখা গেছে শামীম ওসমানকে। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির সাবেক এমপি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরে সময়জুড়েই শামীম ওসমানের কারণে নানামুখী চাপে পড়তে হয়েছে গিয়াসউদ্দিনকে। জেলায় অনেক নেতা থাকলেও গিয়াসউদ্দিনকেই নিজের প্রতিপক্ষ বলে মনে করতেন শামীম ওসমান। শামীম ওসমানের ইন্ধনেই সেসময় গিয়াসউদ্দিন ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বহু মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। এসকল মিথ্যা মামলায় বহুবার কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে।
শামীম ওসমানের সাথে গিয়াসউদ্দিনের দ্বৈরথ মূলত ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে। সেই নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমানকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন গিয়াসউদ্দিন। এঘটনার পরেই নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে আলোচনায় আসেন গিয়াসউদ্দিন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে নারায়ণগঞ্জ শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ওসমান পরিবার। সেসময় বিএনপির অনেক বড় বড় নেতারা জেলা বিএনপির নেতৃত্বে থাকলেও শামীম ওসমান বাহিনীর সামনে দাঁড়াতে পারেনি। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ বিএনপির নেতৃত্বে না থাকলেও দলীয় কর্মসূচিগুলো সফল ভাবে পালন করতে থাকলে শামীম ওসমানের মাথাব্যাথার কারন হয়ে ওঠেন গিয়াসউদ্দিন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় নিজের স্ত্রীর জানাজায়ও অংশ নিতে পারেননি গিয়াসউদ্দিন।
বিগত সময়ে কাজী মনির, তৈমুর আলম খন্দকার, মামুন মাহমুদের মত নেতারা জেলা বিএনপির নেতৃত্ব দিয়ে আসলেও কেউই রাজনীতির মাঠে সুবিধা করতে পারেননি। এর মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে আঁতাত করে রাজনীতি করার অভিযোগও উঠেছিল। দলের সম্মেলন করতে গিয়ে প্রশাসন ও আওয়ামী লীগকে ম্যানেজ করে সম্মেলন করার কথা বলে সেসময় তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন জেলা বিএনপির তৎকালীন সদস্য সচিব মামুন মাহমুদ।
২০২২ সালের আগ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ বিএনপির কোন নেতাকেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতেন না শামীম ওসমান। বরং তৈমূর আলম খন্দকার, মামুন মাহমুদের মত নেতাদের বিভিন্ন টিভি টকশো ও জনসভায় প্রশংসা করতে দেখা গেছে শামীম ওসমানকে। তবে ব্যাতিক্রম চিত্র ছিল মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের ক্ষেত্রে।
২০২২ সালে মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনকে আহ্বায়ক ও গোলাম ফারুক খোকনকে সদস্য সচিব করে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই নড়েচড়ে বসেন শামীম ওসমান। গিয়াসউদ্দিনকে খুনী, সন্ত্রাসী ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আখ্যা দিতে থাকেন নিয়মিত।
এদিকে সভা সমাবেশের বাইরেও গিয়াসউদ্দিনকে ঘিরে নানা কৌশল আঁটেন শামীম ওসমান। এক-এগারোর সময়কার বিভিন্ন মামলা শামীম ওসমানের ইন্ধনে নতুন করে সক্রিয় করা হয়। এসকল মামলায় কারাগারেও যেতে হয়েছে গিয়াসউদ্দিনকে।
এরই মাঝে ২০২৩ সালে জেলা বিএনপির সম্মেলনের মাধ্যমে জেলার সভাপতি নির্বাচিত হন গিয়াসউদ্দিন। সেই সম্মেলনে শামীম ওসমানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে প্রধান অতিথি করেন গিয়াসউদ্দিন।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় গিয়াসউদ্দিনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। ভোটের মাঠে গিয়াসউদ্দিনের এই জনপ্রিয়তায় ভীত ছিলেন শামীম ওসমান। এছাড়াও দল পরিচালনা ও দলকে সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন গিয়াসউদ্দিন। এর ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে শামীম ওসমানকে। দীর্ঘদিন জেলার শীর্ষ নেতারা ওসমান পরিবারের সাথে আঁতাত করে চলার ফলে ফতুল্লা সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় বড় কোন শোডাউন করতে পারেনি বিএনপি। তবে ২০২৩ সালে সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়ে সেসময় শামীম ওসমানের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফতুল্লায় জনসভা করেন গিয়াসউদ্দিন। এই জনসভায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটেছল। নারায়ণগঞ্জে বিএনপি এত বড় শোডাউন করতে পারে সেসময় এমনটা কেউ ধারণাই করতে পারেনি।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরেও শামীম ওসমানের রোষানলে পড়েন গিয়াসউদ্দিন। এসময় আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় দীর্ঘদিন পলাতক থাকতে হয়েছে গিয়াসউদ্দিনকে। জুলাইয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন ছাত্র জনতার আন্দোলনে রুপ নেয় সেসময় ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক এলাকায় শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে বিএনপি। জুলাই থেকে ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগের পতনের আগ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এসকল মামলার বেশিরভাগেই প্রধান আসামি করা হয় গিয়াসউদ্দিনকে।