হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সাথে মতবিনিময়
নারায়ণগঞ্জে শারদীয় দূর্গা পূজায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন দেখা গেছে এবছর। দীর্ঘ সতেরো বছর পর দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সাথে মতবিনিময় করে তাদের পাশে থাকার ঘোষণা দেয় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা যা বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা।
দীর্ঘ সতেরো বছর বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল সম্পর্কে হিন্দু সম্প্রদায়কে জুজুর ভয় দেখিয়ে রাখা হয়েছিল বলে দাবী করে সেসময় বিএনপি নেতারা বলেন, হিন্দু ভাইয়েরা এত বছর আমাদের ডাকেননি। আমরা সবসময় আপনাদের আমাদের ভাইয়ের মতই দেখেছি। আওয়ামী লীগ নিজেদের হীন রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্য হাসিলের জন্য হিন্দুদের আমাদের সম্পর্কে ভয়ভীতি দেখিয়ে রেখেছিল।
দূর্গা পূজা শুরু হওয়ার আগে গত ২৬ সেপ্টেম্বর এক মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিয়ে রাজনীতি হয়। গত ১৩ তারিখ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা বলেছেন, তারা কোন একটি দলের সাথে থাকতে চান না। তারা দেশের স্বার্থে দেশের পক্ষে থাকতে চান।
তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদ পতনের পরে বিভিন্ন ভাবে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে ও সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে কাজ করছে। তাদের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা এখন সচেতন। এখানে আজ অনেক রাজনৈতিক দলের লোকেরা এসেছে। আজ আওয়ামী লীগেরও ভাল লোক এখানে আসলে আমাদের আপত্তি থাকত না। কিন্তু আমাদের সেই অধিকার ছিল না।
তিনি বলেন, আমাদের নেতা তারেক রহমান পূজা উপলক্ষে মিটিং করে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছে। তিনি বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায় যেন আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারে সে অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হবে। আপনারা আপনাদের যেকোন অসুবিধায় আমাদের জানাবেন। প্রশাসন খুব আন্তরিক। আমরা নারায়ণগঞ্জকে সুন্দর রাখতে চাই।
নারায়ণগঞ্জ শহরের বাইরেও সকল থানা ও উপজেলা পর্যায়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশে ছিল বিএনপি নেতাকর্মীরা। গত ১১ অক্টোবর রূপগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে মতবিনিময়ে অংশ নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু বলেন, আওয়ামী লীগ সবসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে বিএনপির বিভেদ সৃষ্টি করতে চেয়েছে। কিন্তু ওরা জানত না যে বিএনপিসহ হিন্দু মুসলিম আমরা সবাই ভাই ভাই। আজ সবাই বলে হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, বিএনপি ছাড়া রক্ষা নাই।
তিনি আরও বলেন, খোকন ভাই এখানে বলেছেন ইতিমধ্যে যে পাহাড়া দিয়ে পূজা করতে হচ্ছে। কেন এটা করতে হচ্ছে। এর কারণ হল একটি পক্ষ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে।
এছাড়াও নারায়ণগঞ্জে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা পূজা মন্ডপের নিরাপত্তায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। নিরাপত্তা নিশ্চিতে মাঠে ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামি ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরাও।
এদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রতি আন্তরিকতায় পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারাও আশ্বস্ত হয়েছিলেন। এবিষয়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর এক মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শিপন সরকার শিপন বলেন, পাঁচ তারিখের পর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যে আতংক বিরাজ করছিল ৭ তারিখ মিটিং হয়েছিল। সেসময় রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য দলগুলো। আমরা এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়েছি। সকলে মিলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এই উৎসব উদযাপন করবো। এটার জন্য আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করছি।
তিনি আরও বলেন, নয় তারিখ থেকে আমাদের এই শারদীয় উৎসব শুরু হবে। দশ তারিখে আমাদের অষ্টমী। এদিন হাজার হাজার ভক্তদের সমাগম ঘটে এখানে। টানবাজার, আমলাপাড়ায়ও প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে। আমরা চাই এই এলাকাগুলোতে পুলিশ মোতায়েন করা হোক।
সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০২৪ সালে শারদীয় দূর্গা পূজা ধুমধামের সাথে পালিত হয়। শুধু নারায়ণগঞ্জ শহরেই ২১৩টি মন্ডপে দূর্গাপূজা উদযাপিত হয়।
পূজা চলাকালে নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ হিন্দু -বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের ভাইস চেয়ারম্যান ও নিতাইগঞ্জের শ্রী শ্রী বলদেব জিউর আখড়া ও শিব মন্দিরের সভাপতি জয় কে রায় বলেন, নারায়ণগঞ্জ হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শহর। এখানে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই মিলেমিশে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপন করছি। প্রশাসনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতারাও আমাদের নানাভাবে সহযোগিতা করছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিপন সরকার শিপন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের ২১৩টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামসহ সব দল আমাদের পাশে আছে। তারা আমাদের স্বেচ্ছাসেবক দিয়েছেন। পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এবার কঠোর অবস্থানে ছিল। মন্ডপগুলোতে সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিল।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার সেসময় নিরাপত্তার ব্যাপারে সকলকে আশ্বস্ত করে সেসময় বলেছিলেন, পুলিশের টহলের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে। দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত পূজা উদযাপন কমিটির সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা যোগাযোগ করছেন। প্রতিটি পূজামন্ডপে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ থাকবে। পাশাপাশি আনসার সদস্যরাও রয়েছে। র্যাব ও সেনাবাহিনীও টহল দেবে। আশা করছি, প্রতি বছরের মতো এবারও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজা পালিত হবে।