মহজমপুরের টাকশাল
ইতিহাস সমৃদ্ধ অঞ্চল প্রাচীন বাংলার রাজধানী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ। সোনারগাঁ প্রাচীন বাংলার রাজধানী হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন সময় এখানে ভিন্ন ভিন্ন শাসকরা তাদের শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। বাংলার প্রাচীন রাজধানী থাকাকালে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ নগরীতে ছিল বেশ কয়েকটি মুদ্রার প্রচলন। শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে সোনারগাঁ থেকে নিজস্ব মুদ্রার প্রচলনও করেছিলেন তৎকালীন রাজন্যবর্গ। আর এসব মুদ্রা তৈরি করা হতো তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁয়ের নিজস্ব টাকশালে।
সোনারগাঁয়ে এ পর্যন্ত দুটি টাকশালের সন্ধান পাওয়া গেছে। দুটি টাকশালের মধ্যে মহজমপুরের টাকশালটি ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সোনারগাঁয়ের জামপুর ইউনিয়নের মহজমপুর এলাকায় ছিল সুলতানী আমলের টাকশালটি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬শ’ শতকে সুলতানী শাসনের শেষ দিকে এখানে শাহী লঙারের মসজিদ ও এতিমখানা ছিল। ইতিহাসে আছে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে সুলতানী আমলের একমাত্র টাকশালটি ছিল তৎকালীন মোয়াজ্জেমাবাদ বর্তমান মহজমপুরে। ইলিয়াছ শাহী বংশের শাসন আমলে অনেক মুদ্রা সোনারগাঁয়ের এ টাকশালে মুদ্রিত হয়েছে।
সোনারগাঁয়ে ইলিয়াছ শাহী বংশের শাসন আমল শুরু হয় ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে। শামসুদ্দিন ইলিয়াছ শাহ ছিলেন এ বংশের প্রথম শাসক। ইলিয়াছ শাহী আমলের অন্যতম শাসক ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ। তার আমলেই সোনারগাঁয়ে স্বাধীনভাবে নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন ঘটে।
সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরের কাছে অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে ক্রোড়ি বাড়ি টাকশাল। প্রায় চার শতাব্দীর পুরনো এ টাকশালটি এখন পরিত্যক্ত একটি ভবন। গৌড়ীয় দোচালা স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এ টাকশালটি চারদিকে রয়েছে পাতলা জাফরি ইটের উঁচু দেয়াল। যা দেখলেই অনুমান করা যায় এ স্থানটি তৎকালীন সময়ে একটি সংরক্ষিত এলাকা ছিল। টাকশালটির উত্তরে রয়েছে বিশাল দীঘি। এক সময়ে দীঘির চারদিকে শান বাঁধানো ঘাট ছিল। বর্তমানে ঘাটের কোন অস্তিত্ব নেই। তবে দীঘিটি আগের মতোই রয়েছে।
স্থানীয় লোকেরা আমিনপুরের এ টাকশালটিকে ক্রোড়ি বাড়ি বলে থাকে। মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে পরগনার রাজস্ব অধিকর্তা ও রাজস্ব সংগ্রাহকের পদবি ছিল ক্রোড়ি। তিনি ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে ১শ’ ৮২ জন ক্রোড়ি নিয়োগ করেছিলেন আর্থিক কাজকর্ম দেখভালের জন্য। ধারণা করা হয় সে থেকেই এ বাড়ির নাম ক্রোড়ি বাড়ি।
মুসলিম এবং হিন্দু স্থাপত্যের অপূর্ব সংমিশ্রণে এ টাকশালটি তৈরি করা হয়েছিল। টাকশালের দেয়ালে রয়েছে লতাপাতাসহ নানা ধরনের অলঙ্করণ। রয়েছে ঢেউ খেলানো খিলান, খিলানের মাথায় রয়েছে বাজপাখি ও পদ্ধফুলের খোদাই করা প্রতিকৃতি। ভগ্নপ্রায় ইমারতে রয়েছে অসংখ্য খুপরি ও কুঠুরি। ভূগর্ভস্থ কুঠুরিগুলোতে সরকারি মুদ্রা ও সোনার মোহর রাখা হতো বলে ধারনা করা হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সোনারগাঁয়ের দুটি টাকশালের মধ্যে একটি বিলীন হয়ে গেলেও জরাজীর্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে ক্রোড়িবাড়ি টাকশালটি। অযত্ন- অবহেলায় বিলীন হওয়ার পথে এ টাকশাল। এখনো পর্যন্ত এটি সংস্কারে কোনো প্রদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অথচ সোনারগাঁয়ের ইতিহাসের সাথে এ টাকশালটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
এরশাদ হোসেন নামে সোনারগাঁয়ের এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, পানাম নগরের কাছেই এই টাকশালটি অবস্থিত। এর সঙ্গে ৪৫০ বছরের ইতিহাস জড়িত। প্রাচীন বাংলার রাজধানী সময়কালের এখানে মুদ্রা সংরক্ষণ করে রাখা হতো। এতো বছর হয়ে গেলেও এটি এখনো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে আওতায় নিয়ে আসা হয় নি। ফলে এ স্থাপনাটি অনেকটাই ধ্বংসের মুখে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে ইতিহাসের সাক্ষী এ টাকশালটিকে সংস্কার করে যেনো সংরক্ষণ করা হয়।
এ বিষয়ে সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদ এলাহী বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। টাকশালটির খােঁজ নিয়ে খুব শীঘ্রই তা সংস্কার করে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করবো।