বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২৫

|

চৈত্র ১৮ ১৪৩১

Advertisement
Narayanganj Post :: নারায়ণগঞ্জ পোস্ট

‘যখন বাড়ি যাই, তখনই আমাদের ঈদ’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ১১:৩৪, ১ এপ্রিল ২০২৫

‘যখন বাড়ি যাই, তখনই আমাদের ঈদ’

ফাইল ছবি

“আমরা যখন বাড়ি যাই, তখনই আমাদের ঈদ। তারপরও ঈদের দিন যখন সবাই পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হয়, তখন কিছুটা খারাপ লাগে।

তবে সেটা সয়ে গেছে। শখের থেকে দায়িত্বটাই আমাদের কাছে বড়। পোশাকের ভেতরেই আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-বেদনা!”

ঈদের দিন সোমবার (৩১ মার্চ) দুপুরে আলাপকালে বাংলানিউজের কাছে কথাগুলো বলছিলেন শাহবাগ থানার কনস্টেবল মো. জাহাঙ্গীর আলম। ঈদে থানার হাজতখানা পাহারার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে সবাই যখন রাজধানী ছেড়ে বাড়ি যায়, তখন নগরীর নিরাপত্তায় থেকে যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। নগরবাসী যাতে নির্বিঘ্নে ঈদ উদযপান করতে পারেন সেজন্য নিজেদের ঈদ আনন্দ বলিদান দেন তারা। বিশেষ এই দিন দায়িত্ব পালন করেই কাটে পুলিশ সদস্যদের। এতে পরিবার থেকে দূরে থাকা এসব মানুষের ক্ষণিকের জন্য মন খারাপ হলেও, দায়িত্বের কাছে সেটি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। আবার দীর্ঘ বছর এভাবেই ঈদ উদযাপন করায় এটি অভ্যাসেও পরিণত হয়েছে তাদের। ফলে দায়িত্বের মধ্যে থেকেই ঈদের আনন্দ খুঁজে নেন তারা।

গত ১৫ বছরের চাকরি জীবনে একবার শুধু পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের সুযোগ হয়েছে কনস্টেবল মো. জাহাঙ্গীর আলমের। তাও আবার ৭-৮ বছর আগে। এ ছাড়া প্রতি ঈদেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মাঠ পর্যায়ে যারা ডিউটিতে থাকে, তাদের ছুটি দিলে শৃঙ্খলা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। আমাদের মানসিকতা সেভাবেই ঠিক করতে হয়। আমার শখ আছে, শখের পাশাপাশি আমাকে জননিরাপত্তাও দেখতে হবে। জননিরাপত্তাই আমাদের কাছে আগে। আমি যদি সাধারণ মানুষের মতো ঈদ আনন্দ চাই, তাহলে আমি পুলিশ হলাম না।

তিনি আরও বলেন, আমি যখন আমি বাড়ি যাব, তখনই আমার ঈদ, তখনই ঈদের মতো আনন্দ লাগে! ঈদের সময় বাড়ি যেতে ইচ্ছা হয়। সবাই যখন ঘুরে বেড়ায়, তখন খারাপ লাগে। তবে দায়িত্বের কাছে সেই খারাপ লাগা কিছুই না। এখানে (থানায়) সবাই আছে, তাদের সঙ্গেই আমাদের ঈদ। এই পোশাকের মধ্যে আমাদের হাজারো কষ্ট, এই পোশাকের মধ্যেই হাজারো সুখ।

ঈদের সকালে সবাই যখন পরিবার নিয়ে রঙিন জামা-কাপড় পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন বিজয় সরণিতে রোদে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছেন মাকসুদুর রহমান। যাতে ঈদের দিন রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক থাকে। ভোর সাড়ে ৬টা থেকে বিজয় সরণিতে দায়িত্ব পালন করা এই ট্রাফিক সদস্য দায়িত্বে মাঝেই আদায় করেছেন ঈদের নামাজ। সেমাই খেয়ে এসেছেন ভোরে বাসা থেকেই।

জানতে চাইলে মাকসুদুর রহমান বলেন, এটা আমাদের কাজ। সবাই তো ঈদে ছুটিতে যেতে পারবে না। সকালে সাড়ে ৬টায় ডিউটিতে আসছি। এরপর থেকে স্ট্যান্ডবাই আছি। মাঝে সাড়ে ৮টায় নামাজে পড়েছি। বাসা থেকে সেমাই খেয়ে আসছি। রাতে রান্না করে রাখছে স্ত্রী।

ঈদে পরিবার ছাড়া দায়িত্ব পালন করতে খারাপ লাগে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশের চাকরিতে থাকলে এটা করতেই হবে। গত ২৭ বছর চাকরি করছি, এটা অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম মন খারাপ হতো। এখন আর হয় না। নতুন এলে তখন আবেগ থাকে।

একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্ব আছেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফাহাদুল আলম। তিনি বলেন, ট্রেনিংসহ ৭ বছর চাকরিতে আছি। এর মধ্যে চারটি ঈদ বাড়িতে করেছি। বাকিগুলো ডিউটি করতে হয়েছে। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট লাগতো। এখন সয়ে গেছে। এখন আর এত খারাপ লাগে না।

ফাহাদুল আলমের তিন বছরের একটি মেয়ে আছে। পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ময়মনসিংহে থাকে সে। মেয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের মেয়ে বলে, বাবার সাথে বেড়াতে যাবে। কিন্তু আমার মেয়ে তো বাবাকে পাচ্ছে না। তার বাবা তো ডিউটিতে। আমাদের এই ত্যাগ জনগণের বোঝা উচিত। বাংলাদেশের জনগণ যেন বোঝে, পুলিশ তাদের বন্ধু, পুলিশ তাদের জন্য কাজ করে। আমি আমার বাসা অরক্ষিত রেখে তাদের বাসা পাহারা দিতে যাই।

তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট প্রদীপ ঘোষ বলেন, চাকরিতে ঢোকার পরে এটা আমার প্রথম ঈদ। ভালোই লাগছে ঈদে ঢাকায় থেকে। সবাই পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। আমারও পরিবারের কথা মনে পড়ে। বাড়ি থেকে অনেকবার ফোন আসছে। বললাম, ঈদে তো সেভাবে ছুটি নেই। সবাই যদি ছুটিতে যায়, তাহলে তো সমস্যা। মা-বাবাকে বোঝালাম, পরে আসব।

তিনি আরও বলেন, ইন প্রফেশন, দেয়ার ইজ নো ইমোশন। জনগণের সেবা করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। সবাই যাতে ভালো করে ঈদ করতে পারে, যানজট না থাকে সেটাই চেষ্টা করছি।

প্রতি বছর ঈদের দিন দুপুরে পরিবারের সবার সঙ্গে খাবার খান সার্জেন্ট এস এম মানসুর আল হাদি। তবে এবার সেটা সম্ভব হয়নি। গুলশান ট্রাফিক বিভাগের এই সার্জেন্ট বলেন, ঈদের সময় সবাই বাড়িতে আসে। প্রতি বছর ঈদের দিন দুপুরে সবাই একসাথে খাবার খাই। কিন্তু এবার সেটা মিস করলাম। করোনার সময় এমন দুই ঈদে মিস করেছি। আমরা জেনে বুঝেই এই পেশায় এসেছি। অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

পরিবার ছাড়া ঈদ করতে খারাপ লাগে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, খারাপ তো লাগেই। কিন্তু আপনি যখন দায়িত্ব, শপথের কথা বিবেচনা করবেন, তখন জনগণের নিরাপত্তাটাই সবার আগে। তারপর আপনি। আপনি তো জনসেবার ব্রত নিয়েই চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। এখন মন খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু সেটা নিয়ে আফসোস করার সুযোগ নেই। আর সময়ের সাথে সাথে কষ্টের বিষয়টা থাকে না। আমরা চাকরি ১০ বছর। চাকরির শুরুতে এই আবেগ থাকে। পরে যখন একটা-দুইটা ঈদ মিস হতে থাকে, তখন এটা অভ্যাসে পরিণত হয়।

ভাসানটেক থানার এসআই আরিফ বলেন, পরিবার ছাড়া ঈদ তো তেমন ভালো যাওয়ার কথা না। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগতো। মানুষ কীভাবে পরিবার ছাড়া ঈদ করে! একটা সময় যখন দেখলাম, আমরা মানুষের নিরাপত্তা দিচ্ছি এটা দেখার পর শান্তি আসে। আমরা তো মানুষের স্বার্থেই কাজ করছি।

শের-ই-বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আমাদের হাসির চেয়ে মানুষের হাসিই আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নিরাপত্তা দেওয়াই আমাদের প্রধান কাজ। তাই স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও ঈদ করতে আমাদের কোনো আফসোস নেই।

ঈদে পুলিশের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ঈদে পরিবার ছাড়া দায়িত্ব পালন করা, এটা দেশের জনগণের প্রতি আমাদের কমিটমেন্ট। এটা আমাদের জন্য তৃপ্তির। এই ত্যাগ আমাদের আনন্দ দেয়। এই বিষয়টা মাথায় রেখেই আমরা জনসেবার উদ্দেশে কাজ করছি। আমরা পেশাদারিত্বে সাথে কাজটি করে যাচ্ছি। এখানে আমরা যে আনন্দ পাই, সেটা আমাদের উৎসাহিত করে।

ঈদের দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যেকই সরকারিভাবে একটা বরাদ্দ পায়। এছাড়া দায়িত্বরত সকল পুলিশ সদস্যদের বিশেষ আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।